• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১৪-১১-২০২২, সময়ঃ বিকাল ০৩:৩৬

এবারও নিরবেই কেটে গেল গোবিন্দগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিমের মৃত্যুদিবসটি

এবারও নিরবেই কেটে গেল গোবিন্দগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিমের মৃত্যুদিবসটি

মহিমাগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি ►  

দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া সন্তানের পথ চেয়ে ৫০ বছর ধরে প্রতীক্ষায় ছিলেন এক নবতিপর মা। গত দু’বছর আগে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে সরকারিভাবে বাড়িসংলগ্ন কবরস্থানে না ফেরা সন্তানের প্রতীকি কবর তৈরি হওয়ায় এখন সেখানেই ঠাঁই নিয়েছেন ওই মা। সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখের আলো প্রায় নিভতে বসা ওই মা আছিয়া বেগম (৯৪) ছেলের কবরটি ছুঁেয় দেখেই শুরু করেন তাঁর প্রতিটি দিন। ছেলে আর ফিরবেনা, তিনি জেনে গেছেন এখন। 

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা ওই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ফজলুল করিম। মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে তাঁর শহীদ হওয়ার স্থান জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়ন পরিষদের নামটি তাঁর নামেই করা। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শত্রুর গুলিতে তিনি শহীদ হন সেখানেই। ছোট্ট একটি ভাঙ্গা ঘরে বসবাস করা মা আছিয়া বেগমের আক্ষেপ, কেউ মনে রাখেনি তার সন্তানের কথা। প্রতি বছরের মতো এবারও নীরবে-নিভৃতেই কেটে গেল দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা তার শহীদ পুত্রের মৃত্যুদিনটি। 

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণপন যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হন মহিমাগঞ্জের অসীম সাহসী মুক্তিসেনা ফজলুল করিম। যুদ্ধপরবর্তী নতুন বাংলাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফজলুল করিমের বীরত্ব আর আত্মদানের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে ওই ইউনিয়নের নামকরণ করা হয় ফজলুপুর। তবে মহান এ যোদ্ধার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিজ এলাকা মহিমাগঞ্জেই এখন অনেকটা অচেনা তিনি। এ বছরের ১৪ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদিবসটিও কেটে গেল একেবারেই নীরবে। মহিমাগঞ্জ বাজারে তাঁর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হলেও কয়েকটি দোকানের সাইনবোর্ডেই তা সীমাবদ্ধ। তাঁর পরিবার রাষ্ট্রীয় সম্মানীভাতা পেলেও ঘর-বাড়ি-চাকুরীসহ অনেক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের।

 ১১ নম্বর সেক্টরের রনজু কোম্পানীর ৩ নম্বর প্লাটুনের প্লাটুনকমান্ডার মহিমাগঞ্জের মকবুল হোসেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম টুকু ও মোজাম্মেল হক জানান, ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর ভোরবেলায় মাত্র ১০-১২ জন মুক্তিসেনা ৮টি মেশিনগান দিয়ে গুলি শুরু করেন ফুলছড়ির দুর্গম চরে পাকিস্তানী সেনাদের একটি দলের ওপর। অতর্কিত হামলায় এ সময় ১১ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং রাজাকারসহ ২০-২৫ জন আহত হয়। বেলা ১১টার দিকে গাইবান্ধা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য এসে স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার এ দলটিকে ঘিরে ফেলে একসময় । “মারবো না হয় মরবো” এ প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে বাঁধের মত বড় একটি আইলকে প্রতিরক্ষাব্যুহ হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের সীমিত অস্ত্র আর মনের অদম্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণপন লড়াই চালিয়ে যান তারা। শুধু নিজেদের রক্ষা নয়-শত্রুনিধনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ১১ নম্বর সেক্টরের রনজু কোম্পানীর ৩ নম্বর প্লাটুনের ১০-১২ জনের এ মুক্তিযোদ্ধার দলটি। পাকিস্তানী সৈন্যদলটি চলে গেলে সূর্য্য ডোবার আগেই ধান ক্ষেতের মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে থাকা আহত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করেন গ্রামের লোকজন। সহযোদ্ধা এবং গ্রামবাসীরা খুঁজে পান সেদিনের যুদ্ধের শহীদ হওয়া মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সেনানী একই মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জের কলেজ ছাত্র ফজলুল করিমের মৃতদেহ। এর মধ্যে গুরুতর আহত মহিমাগঞ্জের তাজুল ইসলাম টুকুকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ভারতের মাইনকারচর ক্যাম্পের হাসপাতালে। আর সম্পুর্ণ আত্মীয়-পরিজনবিহীন অবস্থায় অনাত্মীয় গ্রামবাসী আর সহযোদ্ধাদের হাতে রাতের আঁধারেই কালাসোনারচরের মাটিতে সমাহিত হন শহীদ ফজলুল করিম। 

এক মাস পরে গাইবান্ধা জেলা শত্রুমুক্ত হবার পর ১৩ ডিসেম্বর শহীদের সহযোদ্ধা, ওই প্লাটুনের প্লাটুন কমান্ডার মহিমাগঞ্জের মকবুল হোসেনের কাছ থেকে শহীদ ফজলুল করিমের মৃত্যুর খবর পান তার স্বজনরা। কালাসোনারচরের ১৪ নভেম্বরের যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের অকুতোভয় বীরসেনানী শহীদ ফজলুল করিমের বীরত্ব আর আত্মদানের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে সেখানকার মানুষ ওই এলাকার নাম রাখেন ফজলুপুর। স্বাধীনতার পরপরই তৎকালীন এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের একাংশের নাম বদলে রাখা হয় “ফজলুপুর ইউনিয়ন”। বর্তমানে এটি ফুলছড়ি উপজেলার ৭নং ইউনিয়ন।  

সোমবার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের পুনতাইড় শিংজানি গ্রামে গিয়ে দেখা পাওয়া যায় শহীদ ফজলুল করিমের ভগ্ন বাড়ি ও অসম্পূর্ণ কবরটি। কথা হয় স্বজনদের সাথে। তারা জানান, পুত্র হারানোর ব্যথা বুকে নিয়েই ২০১৬ সালে পিতা দেলোয়ার হোসেন মৃত্যুবরণ করেন বলে জানান শহীদের স্বজনরা। সারাটি জীবন ধরেই সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাওয়া, হুইল চেয়ারে বসা শহীদমাতা ৯৩ বছর বয়সী আছিয়া বেগম জানালেন, এখন নিয়মিত সরকারী রেশন ও রাষ্ট্রীয় সম্মানীভাতা পাওয়ায় তাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসলেও তাঁর সন্তান বা নাতি-নাতনী কেউ সরকারি চাকুরী না পাওয়ায় গভীর মনঃকষ্টে ভুগছেন তিনি। অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামে সরকারি বাড়ি বরাদ্দ হলেও তাদের এখনও থাকতে হয় একটি ভাঙা বাড়িতে। তবে সরকারি উদ্যোগে বাড়ি সংলগ্ন কবরস্থানে শহীদ সন্তানের জন্য একটি পাকা কবর নির্মাণ করে দেয়ায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বর্তমান সরকারের প্রতি।

ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে কবর বিলীন হলেও শহীদ ফজলুল করিমের নামে সেখানে একটি ইউনিয়নের নাম হওয়ায় মানসিক শান্তি যেমন মিলেছে বলে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তার স্বজনরা। সারা বছর না হোক প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর তাঁর শহীদ সন্তানের মৃত্যুর দিনটিকে সবাই স্মরণ করুন এমন আকুতি নিয়েই দিনাতিপাত করছেন শহীদ ফজলুল করিমের নবতিপর বৃদ্ধা মাতা আছিরন বেগম।
মহিমাগঞ্জের এ মহান শহীদের স্মরণে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবী করেছেন এলাকার বিভিন্ন সংগঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন। 
 

নিউজটি শেয়ার করুন


এ জাতীয় আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়