• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২৬-১০-২০২২, সময়ঃ দুপুর ০২:২৪

দৃষ্টিহীন সুরেশের মুদি দোকান

দৃষ্টিহীন সুরেশের মুদি দোকান

ভবতোষ রায় মনা ►

দৃষ্টিহীন সুরেশ চৌধুরীর মুদি দোকানে একের পর এক ক্রেতাকে দেখা যাচ্ছে খরচ কিনতে। কেউ কিনছেন বাদাম, কেউবা ফ্রিজের আইসক্রিম, আবার কেউবা পান-সিগারেট। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের তিস্তামুখঘাট এলাকায় তার দোকানে গিয়ে দেখা গেল এমন দৃশ্য। ক্রেতাদের কাছে দোকানের পণ্য বিক্রিতে ব্যস্ত সুরেশ চৌধুরী। গলার কণ্ঠ শুনেই চিনতে পারেন ক্রেতাটিকে। ক্রেতা পণ্য চাওয়া মাত্র বের করে দিচ্ছেন এবং বিনিময়ে টাকাও গুনে নিচ্ছেন সুরেশ। সবকিছুই করছেন না দেখে। কারণ, দুই চোখে তিনি কিছুই দেখতে পান না।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সুরেশ চৌধুরী। স্বাভাবিক শিশুরা যেভাবে বেড়ে ওঠে সুরেশেও সেভাবেই বড় হয়েছে। সুরেশের মা দেবরতী চৌধুরী জানান, ১১৯৫ সালে আমার বড় ছেলে সুরেশ জ¦রে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয় চিকিৎসাতে কিছুতেই সুরেশের জ¦র কমতে ছিলো না। পরে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে টাইফেয়েট জ¦র ধরা পড়ে। তার শরীরে ইনজেকশন দেওয়া হয়। জ¦র ভালো হলেও ছেলের চোখ দুটো অন্ধ হয়ে যায়। তার পরে অনেক চিকিৎসা করে সন্তানের চোখ ভালো হয়নি। দেশের বাহিরে নিয়ে যেতে বলেছিলো ডাক্তার। অভাবের কারণে তার আর চিকিৎসা করা হয়নি। 
এরপর শুরু হয় কাস টু পাশ দৃষ্টিহীন সুরেশ চৌধুরীর জীবনের সংগ্রাম। অভাবের সংসারের হাল ধরতে ১৯৯৭ সালে গজারিয়া ইউনিয়নে নিজ বাড়ির সাথেই লাগানো স্বল্প পুঁজি দিয়ে ছোট একটি মুদি দোকান শুরু করেন।

তখন ছোট ভাই নিতাইয়ের সহযোগিতায় নিয়ে পাইকারী দোকান থেকে মালপত্র ক্রয় করে নিজ দোকানে বিক্রি করেন। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সুরেশের দোকানে চানাচুর, বিস্কুট, পটটো, বাদাম, পান-সিগারেট, ম্যাচ, কয়েল, মমবাতি, আইসক্রিম, পেপসি, সেভেনআপ, পারুটি, চাল, ডাল, তেল, লবন, আটা, হলুদ, জিরা, গরম-মসলা, হুইল পাউডার, সাবান, সেম্পু থেকে শুরু করে প্রায় সবধরণের পণ্য রয়েছে।
বর্তমানে সুরেশের বয়স ৪৭ বছর। বাবা চাম্পা চৌধুরীকে হারিয়েছেন অন্ধ হওয়ার অনেক আগেই। মা দেবরতী চৌধুরী আজও বেঁচে আছেন, তবে কোন কর্ম করতে পারেন না। সুরেশরা দুই ভাই। ছোট ভাই নিতাই চৌধুরী ফুলছড়ি বাজারের মোবাইল ফেক্সিলোডের ব্যবসা করেন। 

এদিকে ২০০৮ সালে সুরেশ বিয়ে করেন গাইবান্ধার কামরজানির রমেশ সুত্রধরের মেয়ে সম্পা রানীকে। সংসার জীবনে সুরেশ-সম্পা দম্পতির ঘরে দু’মেয়ে সন্তান রয়েছে। মা, ছোট ভাই, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুরেশের পরিবার। বড় মেয়ে শান্তা চৌধুরী ফুলছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে শিল্পা চৌধুরীর বয়স মাত্র ৬ মাস। 

সুরেশের স্ত্রী সম্পা রানী জানান, অন্ধ হলেও আমার স্বামী ভালো মানুষ। নিজের মনোবল নিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিটি কাজে আমি সহায়তা করি। কখন কি লাগবে আমি আগে থেকেই তার সমানে নিয়ে হাজির হচ্ছি। সব মিলিয়ে আমাদের সংসার সুখের। 
দৃষ্টিহীন সুরেশ চৌধুরী বলেন, আমি অন্ধ হওয়ায় ক্রেতারাই আমাকে সহযোগিতা করেন। খরচ নিয়ে সঠিকভাবে টাকা দিয়ে যান। কেউ কোনো দিন আমার অমঙ্গল চাননি। স্বল্প লাভে পণ্য বিক্রি করছি। এ কারণে ক্রেতারাও বেশি আসেন। লাভ কম হলেও বিক্রির পরিমাণ বাড়ে। বর্তমানে খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আমার ১২ হাজার টাকা আয় হয়। আর্থিক সহায়তা বা ঋণ পেলে ব্যবসা আরও এগিয়ে নিতে পারব।’ তিনি আরও জানান, পুরনো টাকা চিনতে কোনো সমস্যা হয় না। তবে নতুন টাকা কেউ দিলে সেই টাকাটা চিনতে আমার সমস্যা হয়। তখন মানুষের সাহায্য নিতে হয়।

সম্প্রতি সুরেশের দোকানে গিয়ে কথা হয় ক্রেতা মিঠু মিয়ার সঙ্গে। তিনি পান-সিগারেট এবং আইসক্রিম কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, সুরেশের দোকানে সব কিছুই পাওয়া যায়। এই গ্রামের যতটি পরিবার আছে সবাই সুরেশের দোকান থেকে সদাই করে। তিনি (সুরেশ) চোখে দেখেন না। কিন্তু পণ্যের নাম বললে কারও সহযোগিতা ছাড়াই তা বের করে দিতে পারেন। পণ্যের টাকা দিলে সুরেশ হাত দিয়ে টাকার পরিমাপ ঠিক করেন। পঞ্চাশ টাকা হলে তার পণ্যের দাম ২৭ টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকা সে ফেরত দিচ্ছেন। শান্ত নামের আরেক গ্রাহক বলেন, স্থানীয় ক্রেতাদের কণ্ঠ শুনলেই চিনতে পারে সুরেশ। কিন্তু কখনও বাহিরের কোন ক্রেতা খরচ নিতে আসলে চিনতে পারেন না। আমি আইসক্রিম চাইলাম ফ্রিজ থেকে বের করে দিলেন। ২০ টাকা দিলাম সুরেশ কাকা ৫ টাকা ফেরত দিলেন।

গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য সাজু মিয়া বলেন, দৃষ্টিহীন সুরেশ অন্যের বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সে নিজেই ব্যবসায়ী করছে। অনেকেই তাঁকে দেখে অবাক হন। সবচেয়ে আচার্য্যর বিষয় হচ্ছে সুরেশ বাটন মোবাইল সেটে যেকোন নম্বর বললেই তিনি মুঠোফোন তুলে ওপর প্রান্তে রিং দিচ্ছেন। পণ্য বেচাকেনার টাকা গণনার জন্যও তাঁর কারও সাহায্য লাগে না। যেকোনো নোট হাতে নিয়ে নিজেই পরিমাণ বলে দিতে পারেন।

ফুলছড়ি বাজার বণিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হবিবুর রহমান বলেন, ‘দৃষ্টিহীন সুরেশ চৌধুরী কারও কাছে হাত না পেতে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজে অনেকেই আছেন, যাঁদের শরীরের সব অঙ্গ ঠিক থাকার পরও অন্যের বোঝা হয়ে থাকেন। সুরেশ তাঁদের জন্য আদর্শ। তাঁকে দেখে আমাদের শিা নেওয়া উচিত। 

ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সুরেশের নামে ২০০৩ সালে সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। প্রতিমাস ৭৫০ টাকা করে তিনমাস পরপর ২২৫০ টাকা ভাতা পাচ্ছে সে। দৃষ্টিহীন হয়েও সুরেশ অন্যের কাছে হাত না পেতে নিজেই তার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যেকোনো সমস্যায় তাঁর সঙ্গে আছি, থাকব।’

নিউজটি শেয়ার করুন


এ জাতীয় আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়