• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ৩০-১১-২০২২, সময়ঃ বিকাল ০৪:২০

নন্দিত আলোকচিত্র শিল্পী কুদ্দুস আলমের জন্মদিন

নন্দিত আলোকচিত্র শিল্পী কুদ্দুস আলমের জন্মদিন

রজতকান্তি বর্মন ►

কুদ্দুস আলম শ্রদ্ধা জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু ফটো সাংবাদিকই নন, একজন নন্দিত আলোকচিত্র শিল্পীও। তিনি কারো কাছে ‘ছবিওয়ালা’, কারো কাছে ‘ছবির কবি’। আজ ১ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। 

অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৭৮ সালে ২৭শ টাকায় কিনেছিলেন ইয়াসিকা ক্যামেরা। তখন ২৭শ অনেক বড় অঙ্কের টাকা। বিভিন্ন ঈদে বাড়ির ছোট্ট সন্তান হিসেবে বড়দের কাছ থেকে পাওয়া বখশিসের টাকা এবং বিভিন্ন সময়ে আত্মীয়-স্বজন বাসায় বেড়াতে এসে আদর করে যে টাকা দিতেন তা জমিয়ে রাখতেন তিনি। সেই ক্যামেরা কেনার ঘটনাও খুব মজার। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে এক বন্ধুর সাথে ঢাকায় গিয়ে কিনে আনেন ক্যামেরা। তাঁর সমবয়সী বন্ধুরা যখন স্বভাবসুলভ দুষ্টমি আর দুরন্তপনায় মেতে থাকতেন তখন তিনি ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার নেশায় ডুবে থাকতেন। অর্থাৎ ক্যামেরা নিয়েই ছিলো তাঁর খেলাধুলা। যেহেতু ফটোগ্রাফির উপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিা ছিল না, তাই তিনি ছবির মান কীভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতেন, নিজে নিজেই পরীা-নিরীা করতেন। ফটোগ্রাফিই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, নেশা-পেশা। শৈশবেই ফটোগ্রাফির প্রেমে পড়া সেই শিশুটিই আজকের কুদ্দুস আলম, লব্ধপ্রতিষ্ঠ জননন্দিত ফটো সাংবাদিক। 

ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিবেন, এমন পরিকল্পনা একেবারেই ছিল না কুদ্দুস আলমের। স্কুল জীবনেই ছবি তোলার অমোঘ টানে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যেতেন। এখনকার মত যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো সহজ ও সুন্দর ছিল না, তখনকার দিনে রাস্তা ছিল ভাঙাচুরা এবং যানবাহনের সংখ্যাও ছিল অপ্রতুল। দূরের যাত্রায় সাথী ছিল বাইসাইকেল। সেই সাইকেলও তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে আগের দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে নিয়ে এসে রেখে দিতেন, তাতে রওনা দিতেন ভোরে। তখন ক্যামেরায় ছবি তোলার পর তা প্রিন্ট করা এখানকার মতো এতো সহজ ছিল না। মফস্বল শহর গাইবান্ধায় তো দূরের কথা, উত্তরাঞ্চলেই কালার ছবি প্রিন্ট করার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। তাই এখানে কালার ফিল্মও পাওয়া যেতো না, কিনে আনতে হতো ঢাকা থেকে। পরিচিত কেউ ঢাকায় গেলে তার মাধ্যমে কালার ফিল্ম কিনে আনাতেন কুদ্দুস আলম। কালার ফিল্মে ছবি তোলার পর আবার তিনি কাউকে দিয়ে তা ঢাকায় পাঠাতেন। তখন কালার ছবির প্রিন্ট পেতে ৪/৫ মাস সময় লাগত। তিনি নিজের চেষ্টায় একা একাই শিখে নিয়েছিলেন ছবির সব ব্যাকরণ। ছবির জন্য তাঁর ত্যাগ, পরিশ্রম, ধৈর্য অবিস্মরণীয়। 

ফটোগ্রাফির প্রতি গভীর প্রেমের কারণেই কুদ্দুস আলম এক সময় নিজেদের বাসার বাথ রুমকে ডার্করুম হিসেবে ব্যবহার করতেন। তবে এ ব্যাপারে তিনি পরামর্শ নিয়েছিলেন গাইবান্ধার প্রবীণ ফটোগ্রাফার বুদ্ধু লালের কাছে। ছবি ওয়াশে কোন মেডিসিন কী অনুপাতে ব্যবহার করতে হবে তা তিনি বুদ্ধ লালের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন।

রোদ নেই, ঝড় নেই, শীত-বাদল বলে কিছু নেই শুধু ছবির নেশায় ছুটে বেড়ান কুদ্দুস আলম। এমনকি প্রচন্ড শীতের মধ্যে মাঝে মাঝে ভোর রাতেও বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়েন ছবির খোঁজে। চরাঞ্চলের শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সী নারী-পুরুষের কাছে তিনি ‘ছবিওয়ালা’ আর আমরা শহরে বলি ‘ছবির কবি’। চরের মানুষ তাঁকে ডাকেন ‘আমাদের ছবিওয়ালা’ বলে, তিনি তাঁদের কাছে সমাদর পান আপনজন হিসেবে। এই ‘ছবিওয়ালা‘ বা ‘ছবির কবি’ কুদ্দুস আলমের বাবা মহির উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন সময়ে গাইবান্ধা শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। মা মরহুম জমিলা খাতুন। এই দম্পতির তিন ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে কুদ্দুস আলম তৃতীয়। 

তিনি প্রথমে বিভিন্ন এনজিওর ছবি তোলার কাজ করতেন। এরপর তিনি প্রথমে গাইবান্ধা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সন্ধান ও পরে দৈনিক আজকের জনগণ পত্রিকায় ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে বনে যান ‘আলোকচিত্র শিল্পী’। ধীরে ধীরে কুদ্দুস আলমের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে গাইবান্ধার গণ্ডির বাইরে। তিনি ২০০০ সালের পর ফটো এজেন্সি দৃক ও ফোকাস বাংলায় যোগদান করেন। বেড়ে যায় ব্যস্ততা, বেড়ে যায় কাজের সীমা-পরিসীমা। 

জাতীয় পর্যায়ে ঢাকার পত্রিকায় মফস্বলের ছবি প্রকাশ পাবে-এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারতেন না। কিন্তু কুদ্দুস আলমই প্রথম আলোকচিত্র শিল্পী যিনি সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর তোলা অসংখ্য ছবি ঢাকার বিখ্যাত সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তাঁর ছবি সংবাদের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। কুদ্দুস আলমের তোলা গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের আলোচিত ঘটনার বহু ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এপি ও এএফপিতে প্রকাশিত হয়েছে। কুদ্দুস আলম প্রমাণ করেছেন কাজের প্রতি, পেশার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হলে মফস্বলে বাস করেও জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হওয়া যায়-সুনাম অর্জন করা যায়। 

একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে কুদ্দুস আলমের রয়েছে অনেক অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। স্পটে ছবি তুলতে গিয়ে তিনি যেমন আতংকজনক ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন, আবার আনন্দিত মুহুর্তেরও মুখোমুখি হয়েছেন। এসব নিয়ে কষ্ট-সুখের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে তাঁর। তাঁর তোলা যতো ছবি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার বহু বহু গুণ বেশি ছবি রয়েছে সংগ্রহে। তিনি যেমন মানুষের ছবি তুলেছেন, তেমনি তুলেছেন মানুষের জীবন, সংগ্রাম, প্রকৃতি, ঋতু বৈচিত্র্য, সমস্যা ও সম্ভাবনার ছবি। কুদ্দুস আলমের ভাষায় ‘সব ছবিই ছবি নয়’। মফস্বলে বাস করেও তিনি ছবিকে কবিতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন-এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
কুদ্দুস আলমের অনেক কাজ জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত হয়েছে। তাঁর তোলা ছবি দিয়ে মোবাইল কোম্পানি সিটিসেল ২০১৫ সালের ক্যালেন্ডার এবং ২০১১ সালে বিপিএলে দুরন্ত রাজশাহী দল লগো করেছিল। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কুদ্দুস আলম এ পর্যন্ত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ২০টি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পুরস্কার লাভ করেছেন। পেয়েছেন গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুণীজন সংবর্ধনাও।  

জীবনে বহু কিছু করার সুযোগ এলেও আজকের ছবিওয়ালা কুদ্দুস আলম কোনো কিছুই করেননি। অন্যকোনো পেশায় জড়িয়ে গেলে জীবনে চকচকে অর্থনৈতিক সাফল্য আসতো। কিন্তু অন্য পেশায় যাবার কথা কোনোদিনই ভাবেননি তিনি। সেই ১৯৭৮ সাল থেকেই এখনও লেগে আছেন ফটোগ্রাফিতে। বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় কাজ করার অনেক আমন্ত্রণ পেয়েছেন, সেসব তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছেন। কুদ্দুস আলম মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে গাইবান্ধায় থেকেছেন এবং এখানেই থেকে যেতে যান আজীবন। 
ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কুদ্দুস আলম সদা হাস্যোজ্জ্বল ও নিরহংকারী। ছবি পাগল এই মানুষটির ‘মধুর অত্যাচার’ মেনে নিয়েছেন স্ত্রী রিটা আলম। পারিবারিক সাপোর্ট বিশেষ করে স্ত্রীর বিরক্তিহীন সহযোগিতা না পেলে ‘ছবির কবি’ বা ‘ছবিওয়ালা’ হয়ে ওঠা হতো না কুদ্দুস আলমের। পারিবারিক সব ঝুট-ঝামেলা, হিসাব-নিকাশ স্ত্রীর উপর চাপিয়ে ছবির জন্য চষে বেড়ান বিভিন্ন জনপদ। রিটা আলমও এইসব দায় মেনে নিয়েছেন হাসিমুখেই। শুভ জন্মদিনে তাঁর প্রতি হার্দিক অভিন্দন ও শ্রদ্ধা। 
 

নিউজটি শেয়ার করুন


এ জাতীয় আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়