শাহজাহান আলী মনন, সৈয়দপুর ►
প্রথম শ্রেণির পৌর শহর সৈয়দপুরের প্রায় সব সড়কেই দূরাবস্থা। বিশেষ করে প্রধান তিনটি সড়ক একেবারে মরণ ফাঁদ। পুরো রাস্তা জুড়ে ভাঙাচোড়া আর খানাখন্দ। চলাচলে চরম ভোগান্তিতে মানুষজন। দীর্ঘ দিন থেকে সংষ্কার না হওয়ায় দূর্ভোগ বেড়েই চলেছে। তবুও এই সমস্যা নিরসনে কোন উদ্যোগ নেই কর্তৃপরে। ফলে পথচলায় ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত সৈয়দপুরবাসী।
শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ ডা. জিকরুল হক সড়কের মদীনা মোড়েই প্রায় ২০ ফুট এলাকাজুড়ে পিচ-পাথরের কার্পেটিং আর ইটের খোয়া উঠে গর্ত তৈরি হয়েছে। চরম ব্যস্ততম এই জায়গাটা একেতো ভাঙা। তার উপর সবসময়ই নোংরা পানি জমে থাকায় যাতায়াত দূর্বিসহ। এখানে রাস্তার দুইপাশে মাছ বাজার, ডিমের আড়ত, কাপড় মার্কেট ও গুড়াটিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পন্যের দোকান থাকায় জনসমাগম বেশি। এতে যান চলাচল আর কেনাকাটা করতে চরম নাজেহাল হতে হয়।
অন্যদিকে জিআরপি মোড় স্মৃতি অম্লান চত্বর থেকে রেলওয়ে কারখানাগামী সড়কের বেহাল দশা। এক কিলোমিটার সড়কের পুরোটাই ভেঙে চৌচির। গর্ত বা খানাখন্দ গুনে শেষ করার জো নেই। এককথায় চলাচল অযোগ্য। যানবাহনে দূরের কথা পায়ে হেটে চলাও দূরহ। তারপরও গুরুত্বের কারণে প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে কষ্ট করেই যাতায়াত করছেন লোকজন।
একই অবস্থা শহীদ জহুরুল হক সড়কের। শেখ রাসেল চত্বর (কলিম মোড়) হতে বাঁশবাড়ী সাহেবপাড়া মিস্ত্রীপাড়া হয়ে বাইপাস পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কে প্রায় ৩০ স্থানে ভাঙা। কিছুদূর পর পরই খানাখন্দ। কোথাও কোথাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। পৌরসভার ৪ টি ওয়ার্ডের নাগরিকদের যাতায়াতের প্রধান রাস্তা। এইপথেই বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের বৃহদাংশের লোকজনের বসুনিয়াপাড়া মোড়, শহরে প্রবেশ ও শহরবাসীর সবজি আড়তে চলাচল।
জনদূর্ভোগের আরেক ভীতিজনক পথ হলো শেরে বাংলা সড়ক। তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটির তামান্না মোড় হতে বাইপাস সড়কের ওয়াপদা মোড় পর্যন্ত করুণ অবস্থা। জেলা শহর নীলফামারীসহ ডোমার, জলঢাকা, ডিমলা উপজেলার সাথে যোগাযোগের রুট এটি। তাছাড়া পৌর ১ থেকে ৫ নং ওয়ার্ডবাসী এবং বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের অন্য অংশসহ কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নবাসীর যাতায়াত এই সড়ক দিয়ে।
শহরের অন্যতম ব্যস্ত ও জনবহুল সড়ক এটি। এর পাশেই প্রতিষ্ঠিত উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র সৈয়দপুর প্লাজাসহ তিনটি বড় সুপার মার্কেট। রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, এলএসডি গোডাউন, বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল, রেলওয়ে স্টেসন। পিডিবি'র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও দেশের সর্ববৃহৎ উত্তরা আবাসন প্রকল্পেও যেতে হয় এই পথ ধরেই।
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর যাবত উল্লেখিত সড়কগুলোর এই দূরাবস্থা হলেও সংষ্কার বা মেরামতের কোন উদ্যোগ নেই। মাঝে শেরে বাংলা সড়কটি ২৮ লাখ টাকা ব্যায়ে মেইনটেনেন্স করা হলেও মাত্র একমাসেই জোড়াতালি দেয়া পিচ-পাথর উঠে পূর্বের অবস্থা। নামকাওয়াস্তে লোকদেখানো ও নিম্নমানের কাজ করায় তা আরও কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
এমতাবস্থায়ও চলাচল করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যায়সহ উঁচুনিচু পথের কারণে অসহ্য ঝাঁকুনির ফলে শারীরিক অসুবিধায় নিপতিত হচ্ছেন সবাই। সেই সাথে যানবাহন ভেঙে বা অচল হওয়াসহ দূর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে অনেকে তিগ্রস্ত ও ব্যাপক নাজেহাল হচ্ছেন। সুস্থরা কোনরকমে যাতায়াত করলেও রোগী, বয়স্ক, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের নিয়ে অবর্ণনীয় দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এই পথগুলো ব্যবহারকারীরা।
এছাড়াও পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডের অধিকাংশ রাস্তার অবস্থাও সংকটাপন্ন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গোলাহাট থেকে সরকারপাড়া, বঙ্গবন্ধু সড়কের রোস্তম মোড় হতে দারুল উলুম মাদরাসা মোড় হয়ে উপজেলা পরিষদ, শেরেবাংলা সড়কের এলএসডি মোড় হয়ে ধলাগাছ মোড়, বাঁশবাড়ী টালি মসজিদ থেকে সাদ্দাম মোড়, চাউলহাটি থেকে কাজীপাড়া মোড়, কিছুণ মোড় থেকে মহিলা কলেজ ও খেজুরবাগ মসজিদ হয়ে কয়ানিজপাড়া ও সরকারপাড়ার রাস্তা, বিজলী মোড় থেকে মুসলিম স্কুল, মুজার মোড় থেকে জামবাড়ী মোড়, আদানীর মোড় থেকে জুম্মাপাড়া হয়ে বাইপাস, মিস্ত্রীপাড়া মন্দির রোড, নতুন বাবুপাড়া হতে সৈয়দপুর সরকারী ডিগ্রি কলেজ, হাতিখানা বানিয়াপাড়া রোড, নতুন টিএন্ডটি অফিস থেকে বাঙ্গালীপুর নিজপাড়া হয়ে আনসার ভিডিপি অফিস রোড, নয়াটোলা মন্দীরের সামনে থেকে কালিমিয়া খানকা হয়ে বিএম কলেজ মোড়, গার্ডপাড়ার গীর্জার দনি মোড় হতে রেলওয়ে হাসপাতালের সামনের ও পিছনের রাস্তা।
মিস্ত্রীপাড়ার ব্যাটারীচালিত অটোচালক সামসাদ বলেন, এমন খানাখন্দ ভরা রাস্তায় চলাচল করা সত্যিই বড় কঠিন। তারপরও নিরুপায় হয়ে গাড়ি চালাই। কিন্তু প্রতিদিনই কোন না কোন ঝামেলায় পড়তে হয়। চাকা পাংচার বা স্প্রিং ভাঙা, লাইট ফিউজ, ব্যাটারী-মটর সংযোগ সমস্যা হওয়া বা অন্য কোন পার্টস নষ্ট হবেই। এতে খুবই তি হচ্ছে আমাদের।
এছাড়াও অনেক সময় ভাঙার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় হেলে গিয়ে অন্যগাড়ির সাথে ধাক্কা লাগাসহ উল্টে যায়। এতে তো আরও সমস্যা। আহত হওয়ার সাথে গালিগালাজ, চর থাপ্পড় খাওয়া ও জরিমানা গুনতে হয়। পেটের দায়ে কষ্ট করে গাড়ি চালিয়ে হালাল রুজি কামাতেও শুধু রাস্তার কারণে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন চাই। দ্রুত সড়কগুলো ভালো করা হোক।
গোলাহাটের যুবক মানিক বলেন, রাস্তাগুলো এতটাই নষ্ট যে, যানবাহনে চড়েও পথচলা মুশকিল। গাড়ির ঝক্কিতে হাড় মাংস থেতলে যায়। সকাল বিকাল যাতায়াত করায় ব্যাথায় জর্জরিত অবস্থা। কিন্তু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাজারে হওয়ায় কষ্ট সত্বেও বাধ্য হয়ে যেতে হয়। বয়স্ক, নারী ও শিশুদের তো আরও কঠিন অবস্থা। আর রোগীর েেত্র অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যবহার।
বোতলাগাড়ী মাঝাপাড়ার গৃহিণী জেসমিন আক্তার বলেন, শহরে যাওয়ার প্রয়োজন হলেই গা শিউরে ওঠে। রাস্তার দূরাবস্থার কথা চিন্তা করেই এমন ভীতি। মিস্ত্রীপাড়া বা গোলাহাট যেদিক দিয়েই যাই দূর্ভোগ পোহাতেই হবে। কি রকম এক নাভিশ্বাস পরিস্থিতিতে যাতায়াত করা। কতবছর থেকে এমন ভোগান্তি অথচ কারোও কোন ভ্রুপে নাই।
বাঁশবাড়ীর বৃদ্ধ আহমদ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু সড়ক (রংপুর রোড), শহীদ তুলশিরাম সড়ক (দিনাজপুর রোড), শহীদ ক্যাপ্টেন মৃধা সামসুল হক সড়ক (ক্যান্টনমেন্ট রোড) সাবেক মেয়র অত্যাধুনিকভাবে তৈরী করায় তা যেমন দৃষ্টিনন্দন হয়েছে, তেমনি চলাচলেও অনেক সুবিধা হয়েছে। এর বাইরে পৌরসভা ৮০ ভাগ সড়কই ভঙ্গুর। রাস্তাগুলোতে যাতায়াতে বুক দুরুদুরু করে। কখন যে কি হয়! এভাবে কি পথচলা যায়?
সিএনজি চালক মাসুদ জানান, নীলফামারী থেকে ওয়াপদা মোড় পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার পথ আসতে যে সময় লাগে। এখান থেকে সৈয়দপুর থানা পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার যেতে সেই সময় লেগে যায়। রাস্তার অবস্থা এতই নাজুক। এর চেয়ে গ্রামেগঞ্জের রাস্তাও অনেক ভালো। এই সরকারের আমলে এত উন্নয়ন হয়েছে। অথচ সৈয়দপুরের রাস্তাগুলো করুণ বেহাল। কেন এমন অবস্থা?
সৈয়দপুর পৌরসভা মেয়র রাফিকা আক্তার জাহান বেবি বলেন, বরাদ্দের অভাবে রাস্তার বড় সংস্কার কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এরই মধ্যে প্রায় তিন কোটি টাকার রাস্তার কাজ করেছি।
উল্লেখ্য, শিল্প ও ব্যবসা সমৃদ্ধ উপজেলা হিসাবে খ্যাত সৈয়দপুর। এই পৌরসভায় দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা, বিমানবন্দর, সেনানিবাস, ১০০ শয্যা হাসপাতাল, বাস টার্মিনাল, ছোট-বড় ৫ শতাধিক শিল্প-কলকারখানা ছাড়াও রয়েছে শতাধিক সরকারি বেসরকারি স্কুল-কলেজসহ আর্মি বিশ্ববিদ্যালয়। পৌরসভার বিগত বাজেটে উন্নয়ন খাতে প্রায় ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারপরও সমৃদ্ধ এই প্রথম শ্রেণির পৌরসভার রাস্তাঘাটগুলোর চরম দশা।