আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ ►
নওগাঁর রাণীনগরে গাড়লের খামার করে সাড়া ফেলেছেন খামারী আব্দুল মান্নান। সঙ্গে ভাগ্যের দুয়ারও খুলেছে তার। তার দেখাদেখি লাভজনক এই পশু পালনে ঝুকছেন অনেকেই। চাকরীর পেছনে না ছুটে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া, দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে ও বেকার মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আব্দুল মান্নান ২০১৭সালে উপজেলার মালশন গ্রামের মালতিপুকুর নামক স্থানে ১৭বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন আমিন হাসান এগ্রো লি: নামে এক সমন্বিত খামার।
এই খামারের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে গাড়ল। এরপর থেকে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মান্নানের খামারে বর্তমানে ছোট-বড় ৭৫টি গাড়ল রয়েছে। খামারে গাড়লের পাশাপাশি গরু মোটাতাজাকরন, দেশী হাঁস-মুরগী ও ছাগল পালন, মাছ চাষসহ বিভিন্ন প্রজাতির বাগানও রয়েছে। বর্তমানে মান্নানের খামারে ১২জন বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
দেখতে ভেড়ার মতই। জীবনচক্রও একই। তবে ভেড়ার চেয়ে আকারে বেশ বড়; মাংসের পরিমাণও দ্বিগুণ প্রায়। স্থানীয়রা তার নাম দিয়েছে “গাড়ল”। ভেড়া পালনের সমান খরচে গাড়ল পালনে বেশি লাভ। তাই উপজেলার অনেকে এখন গাড়ল পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। প্রতিদিনই উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আগ্রহী ব্যক্তিরা মান্নানের খামার দেখতে আসছে এবং তারা পরামর্শ গ্রহণ করছে। ইতিমেধ্যই মান্নানের দেখাদেখি ওই গ্রামসহ তার আশেপাশের গ্রামগুলোতে ছোট-বড় ১৬টি নতুন খামার তৈরি হয়েছে। ওই সব খামারে কেউ গাড়ল, কেউ গরু, কেউ ছাগল, কেউ মাছ আবার কেউ কেউ দেশী প্রজাতির হাঁস-মুরগি পালন করছেন।
উপজেলার মালশন গ্রামের মৃত আব্বাস আলী মোল্লার ছেলে খামারী আব্দুল মান্নান বলেন, আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টির ইচ্ছে থেকেই গাড়লের খামার গড়ে তোলা। তবে প্রথম দিকে একটু লোকসান গুনতে হয়েছে তবে এখন গাড়ল অত্যন্ত লাভজনক একটি খাতে পরিণত হয়েছে। ভেড়াগোত্রীয় এই গাড়লের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। এখানকার খামারিদের কাছ থেকে গাড়লের বাচ্চা কিনে নিয়ে নতুন নতুন খামার গড়ে তুলছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা উদ্যোক্তারা খামার থেকেই বাচ্চা কিনে নিয়ে যায়। আকার ও আকৃতিভেদে শিশু গাড়লের প্রতিটি ৪০০০থেকে ৬০০০হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়াও মাংসের চাহিদার জন্য বিক্রি হয় আরও অনেক গাড়ল। মাংস বিক্রির উপযুক্ত গাড়লের চেয়ে বাচ্চা বিক্রি লাভজনক। স্থানীয় পশু হাটে গাড়ল বিক্রি হয়ে থাকে। তবে বাচ্চা গাড়ল বিক্রি হয় খামার থেকেই। এতে খামারিরা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে শখের বশে অনেকে গাড়লের মাংস খেয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে কয়েকজন মিলে খামার থেকে গাড়ল কিনে শখ মেটানোর কাজটি করে থাকেন।
তিনি আরো জানান, প্রতিদিনই নিত্যপন্যের সঙ্গে খামারীদের সকল উপকরণের দাম লাগামহীন বৃদ্ধি পাওয়াতে আস্তে আস্তে লাভ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতিটি খামারই দেশের অর্থনীতিতে যোগান দেয়া থেকে শুরু করে আমিষের চাহিদা পূরণ করে আসছে। দ্রæত আমার মতো দেশের হাজার হাজার খামারীদের দিকে সরকারের সুদৃষ্টি প্রদান করা প্রয়োজন। অনেক খামারীরা কিন্তু লোকসানের কারণে খামার ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। এতে করে দেশের খামারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এমন হতে থাকলে কিন্তু এক সময় সরকারকে সবকিছুই আমদানী করতে হবে এবং বেকারদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই খামার খাতে সরকারকে ভ’র্তকি দিয়ে হলেও খামারীদের সকল উপকরণের দাম কমে দিয়ে তালিকাভ’ক্ত করে খামারীদের প্রনোদনার আওতায় আনতে হবে। তবেই কিন্তু দেশের সকল প্রকারের খামারীরা নতুন করে খামার সৃজনে উদ্বুদ্ধ হবেন পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার যুবকরাও ছোট ছোট খামার তৈরিতে ঝুঁকে পড়বে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হবে।
উপজেলার বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের আমিনুর রহমান (২৮) পেশায় ছিলেন গাড়িচালক। খামারী মান্নানের দেখাদেখি পেশা বদল করে গেল দুই বছর ধরে তিনি গাড়ল পালন করছেন। শুধু তিনিই নন মালশন গ্রামের আশেপাশে প্রায় ১৬টি খামার তৈরি হয়েছে। একজন রাখালকে সাথে নিয়ে নিজেই গাড়ল পরিচর্যা করেন তিনি। সারাদিন সড়কের পাশে কিংবা মাঠের ফাঁকা জায়গায় চরানোর কাজ করেন তিনি। গাড়ল পালন করে প্রতিবছর তার আয় লক্ষাধিক টাকা, যা দিয়ে দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের অন্যান্য খরচ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চালিয়ে যাচ্ছেন আমিনুর। গাড়লের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা পানি জমে থাকা জমির ঘাস খেতে অভ্যস্ত। ঘাস খাওয়ার জন্য ছাগল পানিতে নামে না। তাই গাড়লের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সহজ।
গিরিগ্রামের খামারী খোরশেদ আলম (৫০) জানান, গাড়ল বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে দুই থেকে তিনটি বাচ্চা প্রসব করে মা গাড়ল ভেড়া। দেশীয় ভেড়ার চেয়ে গাড়ল আকারে প্রায় দ্বিগুণ। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি গাড়লের ৩৫-৫০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। দামও বেশি এবং এর মাংস খেতে সুস্বাদু। যেখানে দেশীয় একটি ভেড়ার ২০-২৫ কেজি মাংস মেলে। প্রাপ্তবয়স্ক একটি গাড়ল ১৫হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। খাবার, আবাস ও পালন পদ্ধতি দেশীয় ভেড়ার মতই।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কামরুন নাহার জানান, উপজেলায় একমাত্র মান্নানই বাণিজ্যিক ভাবে গাড়লের খামার করেছেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে মান্নানকে সব সময় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আরো বড়ধরনের সহযোগিতা পেলে খামারকে আরো সম্প্রসারিত করতে মান্নানের অনেক সহজ হতো। দেশে ভেড়ার উন্নত জাত তৈরীর বিষয়ে কোন গবেষণা কিংবা প্রকল্প নেই। তাই চাষিদের এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে পুরো উপজেলায় গাড়ল ভেড়ার জাত ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি জাত উন্নয়ন ও পালন বিষয়ে আগ্রহী খামারি কিংবা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ জাত সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনীতিতে আরো সুবাতাস বয়ে যাবে বলে আশার কথা শোনান তিনি।