Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • ৫ ঘন্টা আগে
  • ২৯ বার দেখা হয়েছে

খাঁচা ছাড়ল অচিন পাখি

খাঁচা ছাড়ল অচিন পাখি

মাধুকর ডেস্ক►

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’, কিংবা ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’– লালন ফকিরের এসব গান একাকার হয়েছে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে। তাঁর গাওয়া লালনের গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে চলেছে পাঁচ দশক ধরে। তিনি পেয়েছেন ‘লালনকন্যা’ আখ্যা। লোকসংগীতের বরেণ্য এই শিল্পী জাগতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করে পাড়ি দিয়েছেন অচিন দেশে।

শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফরিদা পারভীন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সর্বত্র। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা ফরিদা পারভীনের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা।

দীর্ঘদিন ধরেই কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। সপ্তাহে দুদিন নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হতো। ২ সেপ্টেম্বর ডায়ালাইসিসের জন্য মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তিনি ছিলেন হাসপাতালের আইসিইউতে। গত বুধবার তাঁর অবস্থা আরও গুরুতর হলে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়।

ইউনিভার্সেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী বলেন, বুধবার থেকেই ফরিদা পারভীনের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তাঁর কিডনি ও মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। রক্তের ইনফেকশন পুরো শরীর ছড়িয়ে পড়ে। শেষ মুহূর্তে সর্বোচ্চ মাত্রার ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে গেছেন।’

ফরিদা পারভীনের মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ রোববার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নিয়ে বাদ জোহর জানাজা হবে। তবে তাঁকে কোথায়, কখন দাফন করা হবে– সে বিষয়ে শনিবার রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।

১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়ায় ফরিদা পারভীনের জন্ম হয়। তাঁর জীবন কেটেছে গানের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে তিনি পেশাদার সংগীতজীবন শুরু করেন। বাবা দেলোয়ার হোসেনের ছিল সংগীতের প্রতি অগাধ ভালোবাসা; দাদিও গান করতেন। পরিবারের সেই উত্তরাধিকার, বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় বেড়ে ওঠা আর নানা ওস্তাদ-গুরুর কাছ থেকে তালিম নেওয়াই ফরিদাকে গড়ে তোলে পূর্ণাঙ্গ শিল্পীতে।

শৈশবে মাগুরায় থাকাকালীন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তাঁর গানের হাতেখড়ি। পরে নজরুলসংগীত, আধুনিক গান সবই করেছেন। কিন্তু তাঁর জীবনের আসল পরিচয় লালনসংগীত। কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালে পারিবারিক বন্ধু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে প্রথম লালনের গান শেখা ‘সত্য বল সুপথে চল’। তার পর থেকে ফরিদা পারভীন আর থেমে থাকেননি। একে একে খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই, করিম সাঁইসহ অসংখ্য গুরুর কাছে তালিম নিয়েছেন।

১৯৭৩ সালের পর থেকেই লালনের গান হয়ে ওঠে ফরিদা পারভীনের জীবনের মূলধারা। ঢাকায় আসার পর তাঁর কণ্ঠে রেকর্ড হয় ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’সহ অসংখ্য গান। প্রায় পাঁচ দশক তিনি লালনের গান করেছেন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে লালনের দর্শন ছড়িয়ে দিয়েছেন ফরিদা পারভীন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে তাঁর কণ্ঠে লালনের গান প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

শুধু লালনের গান নয়, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানেও ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ পেয়েছে অপরিসীম জনপ্রিয়তা। ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’– এসব গানও অমর হয়ে আছে তাঁর কণ্ঠে।

ফরিদা পারভীন লোকগানের রানী, লালন ফকিরের বাণীর অনন্য দূত। তাঁর কণ্ঠে লালনের গান মানেই এক গভীর ধ্যান, আধ্যাত্মিকতার দরজা খোলার আহ্বান। ফরিদা পারভীন চলে গেলেও মানুষের হৃদয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর বেজে যাবে চিরকাল।

তথ্যসূত্র: সমকাল

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad