পীরগঞ্জ(রংপুর) প্রতিনিধি
২৮ মাস মেয়াদী প্রকল্পের সেতুর নির্মাণ কাজ বিগত চার বছরেও শেষ হয়নি। উপরন্ত নির্মান কাজ শেষ না করেই লাপাত্তা হয়েছে ঠিকাদার। রংপুরের পীরগঞ্জে পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গত ২০১৮ সালে করতোয়া নদীর ওপর নুনদহঘাট সেতু ও জয়ন্তীপুর ঘাট সেতু দুটির কাজ শুরু হয়। এখনো অধিকাংশ কাজই বাকি। নির্মাণ হয়নি সংযোগ সড়কও। বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে নৌকা ও বাঁেশর সাঁকোয় পার হচ্ছে দুই জেলার পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষ। ফলে যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে দূর্ঘটনা। স্থানীয়দের মতে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না করা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতায় এমনটি হয়েছে।
দ্রুত সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার দাবি তাদের। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান,২০১৩ সালের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও পীরগঞ্জ আসনের এমপি ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী পীরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলার মানুষের উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থা নিশ্চিতের লক্ষে করতোয়া নদীর উপর এ সেতু নির্মানে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ সিআইবি প্রজেক্টের মাধ্যমে করতোয়া নদীর ওপর জয়ন্তীপুর ঘাটে গোপিনাথপুর সড়কে ১৫ শত মিটার চেইনিজে ২৯৪ মিটার দৈর্ঘ্য ৯.৮ মিটার প্রস্থে ফুটপাতসহ এ সেতু নির্মানের জন্য প্রাক্কলিত মূল্য ২৯ কোটি ৪৮ লক্ষ ৯৪ হাজার ২শত ৩ টাকা বরাদ্দ দেয়।
এছাড়াও রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সীমানায় ৩৮৭ মিটার ও দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা সীমানায় ৪৫০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয়। সেই সাথে একই প্রকল্পের আওতায় চতরা জি,সি গিলাবাড়ী ঘাট ভায়া নিশ্চিন্তবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কে নুনদহ ঘাট পর্যন্ত ৪ হাজার ৫ শত মিটার চেইনিজে করতোয়া নদীর উপর ৩০১ মিটার দৈর্ঘ্য ৯.৮ মিটার প্রস্থে ফুটপাতসহ এ ব্রীজের নির্মাণের জন্য প্রাক্কলিত মূল্য ২৬ কোটি ৮২ লক্ষ ৩৩ হাজার ৮শত ৭৮ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। এখানেও রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সীমানায় ২৫০ মিটার ও দিনাজপুরের সীমানায় ১৫০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করার কথা। ২০১৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদের স্পিকার ও পীরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এমপি সেতু দুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
টেন্ডারের মাধ্যমে কার্যাদেশ পেয়ে বিগত ২০১৮ সনের ৯ মে চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিপি এলজেভি ৫২ ছাত্তার ম্যানসন ও প্যান্স লাইন্স সেতুর নির্মান কাজ শুরু করে। শর্তানুযায়ী বিগত ২০২০ সনের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখের মধ্যে উক্ত কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা । অথচ অদ্যবধি নুনদহ ঘাট সেতুর ৪৪ শতাংশ এবং অপর সংযোগ সেতুর ৩৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ স্থগিত রেখে লাপাত্তা হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ২৮ মাস মেয়াদী প্রকল্পের আওতায় সাধারণ জনগণের চলাচল, শিক্ষা ও চিকিৎসা, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে করতোয়া নদীর ওপর শুরু হয় সেতু নির্মাণ কাজ। কিন্তু এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ ভাগ কাজ। একাধিকবার কাজের মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ না করেই পালিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, নিত্য প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জয়ন্তীপুর ঘাটে সেতু নির্মাণ শেষ না হওয়ায় বাঁশের সাঁকো বেয়ে নদী পারাপার হচ্ছে। অপরদিকে নুনদহঘাট সেতুতে নৌকায় পারাপার হচ্ছেন মানুষজন। কিন্তু ভারী মালামাল, অসুস্থ রোগীসহ অন্য সামগ্রী নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে দীর্ঘ পথ। ফলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দুই জেলার বাসিন্দারা। এর আগে নুনদহঘাট সেতুর পিয়ারক্যাপে ফাটল দেখা দিলে এলাকাবাসীর মধ্যে কাজের মান নিয়ে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। বিভিন্ন মাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ঠ দপ্তর আটা দিয়ে পিয়ারক্যাপের ফাটল বন্ধ করেন। এতে ফুসে ওঠে এলাকাবাসী।
ঘোড়াঘাট উপজেলার ভেলামারী গ্রামের শিক্ষার্থী শাহিন জানায়, আমার বাড়ি নদীর ওপাড়ে হলেও লেখাপড়ার জন্য গিলাবাড়ি স্কুলে যাই। প্রতিদিন নৌকা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে আমাকে পার হতে হয়। বৃষ্টি হলে স্কুলে যাওয়া যায় না। জয়ন্তিপুরের তৈয়ব উদ্দিনের ছেলে শামীম মিয়া বলেন, এভাবে কতদিন চলবে। অর্ধেক কাজ হওয়ার পর বন্ধ আছে। চার-পাঁচ বছর ধরে চলছে এ কাজ। কেউ কোনো ফসলাদি এখান দিয়ে আনা নেয়া করতে পারছে না। ভ্যান-রিকশা তো যাওয়ার কোন উপায় নেই। ফলে দুর্ভোগের শেষ নেই। গিলাবাড়ি গ্রামের জুয়েল নামের এক শিক্ষক জানান, চার বছর আগে এখানে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু আজও শেষ হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে কাজ। একই গ্রামের শাফিউল নামের আর এক শিক্ষক বলেন, এ পথ দিয়ে রোগী, ফসলাদিসহ ভারী কোনো মালামাল নেওয়া যায় না। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় আজ দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অর্ধেক কাজ করে পালিয়েছে ঠিকাদার।
নবাবগঞ্জ উপজেলার মাহমুদ ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুলের ছেলে নুর ইসলাম বলেন, চার বছর ধরে সেতুর কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র অর্ধেক কাজ। এ অবস্থায় স্কুল-কলেজের বাচ্চা ও বৃদ্ধসহ সবার চলাচল খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। পথচারী আল আমিন বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাঁকোর ওপর দিয়ে পারাপার হচ্ছে সবাই। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় কে নেবে? গাড়িতে কেউ এলে ওই পারে নিয়ে যেতে পারেন না। এখানে নেমে হেঁটে পার হতে হয়। ওই পারে গাড়ি নিয়ে যেতে হলে প্রায় পাঁচ-সাত কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় লাগে, আবার রাস্তাও খারাপ। সেতু না থাকায় বিপদ-আপদে বা জরুরী প্রয়োজনে অনেকে সময় মতো যেতে পারে না। যার কারণে তাদের সবার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। দ্রুত সেতুটির কাজ শেষ হলে হাজারো মানুষের উপকার হবে।
পীরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো.মশিউর রহমান দেশ রুপান্তরকে বলেন,সেতু দুটি নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যুনদহঘাট ব্রীজের চুক্তির ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্নের হিসেব দিয়েছি। এ সেতুর রি-টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। জয়ন্তীঘাট সেতুর রি-টেন্ডার হয়েছে। এ ব্রীজের কাজ প্রায় ৬০ শতাংশ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ওই ঠিকাদার যতটুকু কাজ করেছে তাকে সে পরিমাণ বিল দেওয়া হয়েছে, কাজের অতিরিক্ত কোনো টাকা দেয়া হয়নি।