Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১০-১২-২০২৫, সময়ঃ দুপুর ১২:৪৮

গাইবান্ধার আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি

গাইবান্ধার আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি

আদিবাসীদের সংগ্রাম—ছবি: কুদ্দুস আলম।

প্রবীর চক্রবর্তী►

গাইবান্ধা জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। গাইবান্ধা সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর উপস্থিতির কারণে পরিচিত। এখানে সাঁওতাল, ওরাঁও, পহান, মাহালি, মুণ্ডা, কোলসহ বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষিকাজ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক কাঠামো গাইবান্ধার সামগ্রিক সমাজ ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সমতলের অন্যান্য জেলার মতো গাইবান্ধাতেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি আজ গভীর সংকটের মুখে। ভূমি হারানো, সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবায় বঞ্চনা, সহিংসতা, শ্রমশোষণ এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় সংকট- এসব চ্যালেঞ্জ তাদের জীবনধারাকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলেছে।

গাইবান্ধায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ভূমি অধিকার। ঐতিহাসিকভাবে জমিই ছিল তাদের পরিচয়, জীবন ও জীবিকার মূল ভিত্তি। কিন্তু জমির মালিকানা দলিল না থাকা, প্রভাবশালী গোষ্ঠী কর্তৃক জমির দখল, মামলা-মোকদ্দমা এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা- এসব কারণে বহু পরিবার বছরের পর বছর ধরে ভূমি হারিয়ে দারিদ্র্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। সাঁওতালদের জমি দখলের ঘটনা, ক্ষেত-খামারে প্রবেশে বাধা, ফসল লুট বা আগুন লাগানোর মতো সহিংসতা প্রায়ই স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে উঠে আসে। জমি রক্ষার জন্য প্রতিবাদ, মানববন্ধন বা অভিযোগ করলেও বিচার না হওয়া এবং প্রভাবশালী মহলের চাপের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ন্যায্য অধিকার পায় না।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার এখনো সীমিত। অনেক পরিবার দারিদ্র্য, অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভাষাগত বাধা এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণে শিশুদের নিয়মিত স্কুলে পাঠাতে পারে না। শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে ইটভাটা, কৃষিখামার বা দিনমজুরির কাজে ্নিয়োজিত হয়। আদিবাসী ভাষাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় ছোট শিশুদের শুরুর শিক্ষাজীবনেই অসুবিধা তৈরি হয়। স্বাস্থ্যসেবায়ও একই চিত্র। কমিউনিটি ক্লিনিক বা হাসপাতালে গেলে অনেক সময় বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ পাওয়া যায়। মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি, টিকাদান এবং শিশুর স্বাস্থ্যসেবা- এসব খাতে তাদের অংশগ্রহণ অপ্রতুল থাকার কারণে পুরো সম্প্রদায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

অর্থনৈতিক শোষণও গাইবান্ধার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বড় একটি সমস্যা। জমি হারানোর পর অনেকে দিনমজুরির কাজে যুক্ত হলেও তাদের মজুরি সমান নয়। অনেক সময় মৌসুমে কাজের সংকটে অভুক্ত থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ইটভাটায় আদিবাসী নারী-পুরুষ ও শিশুদের শ্রমশোষণ, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করানো এবং মজুরি বঞ্চনার ঘটনা নিয়মিত শোনা যায়। নারীরা দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার। একদিকে আদিবাসী পরিচয়ের কারণে বঞ্চনা, অন্যদিকে নারী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও হয়রানি। যৌন হয়রানি, গৃহস্থালিকাজে শোষণ, জোরপূর্বক শ্রমের মতো সমস্যাগুলো তাদের জীবনে স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি করে।

সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণও গাইবান্ধার মানবাধিকার পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসব, নৃত্য, সংগীত, বিশ্বাস-অনুষ্ঠান, ভাষা এখন নানা চাপে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত সহযোগিতা বা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ না থাকায় অনেক ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। গণমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি সীমিত, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাদের অংশগ্রহণ খুব কম। এ কারণে নীতি-নির্ধারণে তাদের চাহিদা ও সমস্যাগুলো প্রতিফলিত হয় না।

সংগঠন ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক এলাকা রাজনৈতিক প্রভাবাধীন হওয়ায় আদিবাসী নেতারা নির্ভয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করা, মামলা করা বা আইনগত সহায়তা নেওয়াও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বিচারহীনতার একটি দুষ্টচক্র সৃষ্টি হয়; যা আরও বেশি লঙ্ঘনের সুযোগ বাড়িয়ে দেয়।

অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব যদি জেলা প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকর ব্যবস্থা, আদিবাসী ভাষাভিত্তিক শিক্ষা সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য রোধ, সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ, শ্রমবাজারে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত। স্থানীয় সরকার, মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করলে পরিস্থিতির বাস্তব উন্নতি সম্ভব।

সবশেষে বলা যায়, গাইবান্ধার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার কেবল একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যা নয়; এটি ন্যায়, সমতা, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রশ্ন। তাদের অধিকার সুরক্ষিত হলেই এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সামাজিক সম্প্রীতি ও মানব উন্নয়ন আরও শক্তিশালী ভিত্তি পাবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, অবলম্বন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad