Ad
  • মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১৮-৪-২০২৩, সময়ঃ দুপুর ০২:১৫

গোপাল চন্দ্র বর্মন একজন বৃক্ষপ্রেমি শিক্ষানুরাগী ও চারুকারু শিল্পী

গোপাল চন্দ্র বর্মন একজন বৃক্ষপ্রেমি শিক্ষানুরাগী ও চারুকারু শিল্পী

নিজস্ব প্রতিবেদক ►

গাইবান্ধা দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে নিজ প্রচেষ্টায় কর্ম উদ্যোগী অদম্য যুবক গোপাল চন্দ্র বর্মন একজন বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষানুরাগী চারুকারু শিল্পী। শিশুদের কল্যাণে নিবেদিত একজন সুন্দর মনের মানুষ। ইতিমধ্যে তার এই কৃতকর্মের জন্য সে গাইবান্ধা জেলাসহ সারাদেশে তার নামটি ছড়িয়ে গেছে। তাকে নিয়ে দেশের জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। সে একাধারে বৃক্ষপ্রেমী, শিশু জন্মের খবর পেলেই নিজ উদ্যোগে একটি বৃক্ষ ঐ বাড়ীতে স্বহস্তে রোপণ করেন। শিক্ষায় অনুরাগী হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

চারুকারু শিল্পী হিসাবে অতি সম্প্রতি গাইবান্ধা শহরের মাস্টারপাড়ায় আর্ট একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। পাশাপাশি হ্যান্ড প্রিন্টিং এর মাধ্যমে শাড়ী কাপড়, পাঞ্জাবী, ফতুয়াসহ রকমারী নকশায় কাজ করে চলেছেন। 
এলাকায় যখনই কোনো শিশুর জন্মের খবর পান, তখনই গাছের চারা হাতে নবজাতকের বাড়িতে ছুটে যান তিনি। নিজের হাতে বাড়ির আঙিনায় চারাটি রোপণ করেন। নবজাতকের মা-বাবাকে চারা গাছটির নিয়মিত যতœ নেওয়ার পরামর্শ দেন। নবজাতকের জন্য বৃক্ষ ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নিয়ে সে গত তিন বছরে ৯০৫ নবজাতকের বাড়িতে গাছ লাগিয়েছেন গোপাল চন্দ্র বর্মণ। এর বেশির ভাগই ফলদ বৃক্ষ।

গোপাল চন্দ্র বর্মণ পেশায় একজন শিক্ষক ও একজন সুদক্ষ চারুকারু শিল্পী। তার বয়স ৩২ বছর। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় তাঁর বাড়ি। শিশু জন্মের সঙ্গে গাছ লাগানোর সম্পর্ক কী জানতে চাইলে গোপাল চন্দ্র এ প্রতিবেদককে তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। এই কারণগুলির মধ্যে রয়েছে এক. শিশুর বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দরকার। গাছ অক্সিজেন দেয়। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে গাছের সংখ্যা খুবই কম। শিশু বড় হলে তার অক্সিজেনের চাহিদা বাড়বে, গাছও বাড়তে থাকবে আর অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াবে। দুই. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং তিন. শিশুর সঙ্গে সঙ্গে গাছটি বড় হয়ে ভবিষ্যতে আর্থিক সহায়তা দেবে শিশুর পরিবারকে।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সাঘাটা উপজেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের মথরপাড়া গ্রাম। এখানেই গোপাল চন্দ্র বর্মণের বসবাস। তিনি ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ এপ্রিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯০৫টি শিশুর বাড়িতে গাছের চারা লাগিয়েছেন। এর মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কমলা, মাল্টা, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া অন্যতম। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বটতলা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৩৮০ জন ছাত্রছাত্রীকে বিনা মূল্যে গাছ সরবরাহ করেছেন তিনি। প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নানা অনুষ্ঠানে বিনা মূল্যে গাছ বিতরণ করে থাকেন। 

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। ওই সময় তাঁর ভাবনায় আসে, যখন একটি শিশু জন্মায়, তখন প্রকৃতি থেকে সে অক্সিজেন নেয়। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আর গাছই দিয়ে থাকে সেই অক্সিজেন। তাহলে নবজাতকের বাড়িতে গাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন সাঘাটার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের উত্তর মথরপাড়া গ্রামের গৃহবধূ শিউলি বেগম। 

লোকমুখে খবর পান গোপাল চন্দ্র। তিনি একটি আমগাছের কলম নিয়ে ওই বাড়িতে হাজির হন। বাড়ির লোকজন উদ্দেশ্য জেনে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। বাড়ির উঠানের পাশে গর্ত খুঁড়ে গোবর সার দিয়ে গাছটি রোপণ করে দেন। শিশুটির বাবা আবদুর রাজ্জাক ব্যাপারী  বলেন, গোপালদা আমার ছেলে শিফাতের জন্মের খবর শুনে একটি আমগাছ লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। ছেলের বয়স এখন ৩ বছর ১০ মাস, গাছের বয়সও তাই। গত মৌসুমে আমও ধরেছিল গাছটিতে।

খুব খুশি লেগেছে ফল দেখে। ওই বছরের ২৮ মে জন্ম নেয় সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়নের পাচিয়ারপুর গ্রামের রুনাইয়া আহম্মেদ। শাহিনা বেগম নামের এক স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে খবর পান গোপাল। এবারও একটি আমের চারা নিয়ে নবজাতকের বাড়িতে হাজির তিনি। রুনাইয়া আহম্মেদের বাবা স্কুলশিক্ষক শামসুজোহা মিয়া বলেন, আমি তাঁর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, মানুষের সঙ্গে গাছের স¤পর্ক আছে। গাছটি বড় হলে ফল পাওয়া যাবে, পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।

একই ইউনিয়নের উল্লাসোনাতলা গ্রামে ২০১৬ সালের জুন মাসে জন্ম নেয় মুগ্ধ বাবু। এক স্কুলছাত্রের কাছে ওই শিশুটির জন্মের খবর পেয়ে বাইসাইকেলে করে একটি লিচুগাছের চারা নিয়ে চলে যান নবজাতকের বাড়িতে। শিশুটির বাবা কৃষক মানিক মিয়া বললেন, গাছটি বড় হয়েছে। ছেলের মতো গাছটিরও যত্ন করছি। আশা করছি অল্প দিনের মধ্যে ফল পাব।

গত বছরের ১৪ আগস্ট জন্ম নেয় ঘুড়িদহ ইউনিয়নের বাউলিয়া গ্রামে সাবিদ সরকার। স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে খবর পেয়ে একটি কমলাগাছ নিয়ে ছুটে যান গোপাল। শিশুটির মা ফাতেমা বেগম বললেন, আমার স্বামী ঢাকায় সিএনজি চালায়। দুই ছেলে আমার। সন্তানের জন্য গাছ লাগানোর কথা কখনো ভাবিনি। গোপালদা ছেলের জন্মের কথা শুনে গাছ দিয়েছেন। খুব ভালো লাগল। ফল বিক্রি করে ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারব।

নিজের স্কুলের ছাত্রছাত্রী, ব্র্যাকের স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী, কমিউনিটি ক্লিনিকের নার্সদের কাছ থেকে শিশু জন্মের খবর পান গোপাল চন্দ্র। এর মধ্যে অন্যতম সংবাদদাতা সাঘাটা ব্র্যাক স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মী শাহিনা বেগম। শাহিনা বললেন, সাঘাটার ঘুড়িদহ, কচুয়া ও কামালেরপাড়া ইউনিয়নে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার কাজ করি। এই তিনটি ইউনিয়নে প্রতি মাসে গড়ে সাত-আটটি শিশু জন্ম নেয়। গোটা উপজেলায় আমার মতো স্বাস্থ্যকর্মী আছেন ১০ জন। গোপালদার উদ্যোগটি অসাধারণ। তাই আমরাই সব স্বাস্থ্যকর্মী সন্তান জন্মের খবর পেলে দ্রুত দাদাকে জানাই।

গোপাল চন্দ্র বর্মণের জন্ম সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়নের উল্লাসোনাতলা গ্রামে। বাবা কৃষক কমল চন্দ্র বর্মণ। বর্তমানে ঘুড়িদহ ইউনিয়নের মথরপাড়া গ্রামে বসবাস করেন গোপাল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে গোপাল সবার ছোট। বড় ভাই কালিপদ চন্দ্র বর্মণ ব্যবসা করেন। একমাত্র বোন কৃষ্ণা রানীর বিয়ে হয়েছে। গোপাল চন্দ্র ২০১৪ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী সাথী রানী বটতলা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক। একমাত্র মেয়ে অন্বেষা রানীর বয়স আড়াই বছর। মেয়ের জন্মের পর তিনি নিজ বাড়িতেও মাল্টাগাছ লাগিয়েছেন।

গোপাল চন্দ্র ২০০১ সালে বোনারপাড়া কাজী আজাহার উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। অভাব-অনটনের কারণে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তিনি বগুড়ার কাহালু উপজেলায় কৃষিশ্রমিকের কাজ নেন। এরপর সাতরং নামের বগুড়ার একটি আর্ট স্কুলে চাকরি নেন। সেই উপার্জন দিয়ে তিনি ২০১৩ সালে বগুড়া আর্ট কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে গত বছর এপ্রিলে বিএফএ পরীক্ষা দিয়েছেন। এখনো ফলাফল বের হয়নি।

এর মধ্যেই ২০০৮ সালে গোপাল চন্দ্র বটতলা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুল নামে নিজের গ্রামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্কুলটিতে প্লে থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৮০ জন ছাত্রছাত্রী আছে। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ১৭। গোপাল চন্দ্র স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।

সাঘাটার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজাদ মিয়া, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুবিনুজ্জামান চৌধুরী, উপজেলা কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব আজিজুর রহমান গোপালের ভূয়সী প্রশংসা করেন। গোপালের স্ত্রী সাথী রানীও তার এই সুন্দর উদ্যোগের জন্য পাশে থেকে নানা সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। গোপাল চন্দ্র ভবিষ্যতে গোটা জেলায় তাঁর এই কাজ ছড়িয়ে দিতে চান। এর জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তিনি।

উল্লেখ্য ছবি আকার প্রতি তার দুর্বলতা রয়েছে। নতুন প্রজন্মকে আধুনিক রং তুলির স্পর্শে চিত্রাংকন বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে সে গাইবান্ধা শহরের মাস্টারপাড়ায় আর্ট একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। যেখানে বেশকিছু ছাত্রছাত্রী শুক্র ও শনিবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুশীলন করছে। পাশাপাশি হস্ত ও কুটিরশিল্প প্রসারে শাড়ী কাপড়ে নানা ধরনের আল্পনা অংকন করে চলেছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Ad

এ জাতীয় আরো খবর
Ad
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
Ad