ভবতোষ রায় মনা ►
পাপমোচনের আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তরা ব্রহ্মপুত্র নদে গঙ্গাস্নান উৎসবে ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরিতকি, ডাব, আম পাতাসহ পিতৃকুলের উদ্দেশ্যে নদের জলে অর্পণ শেষে নদীতে ডুব দিয়ে তারা স্নান করছেন। পবিত্র এ অষ্টমী স্নানকে কেন্দ্র করে গাইবান্ধার ফুলছড়ির তিস্তামুখ ও বালাসীঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে মেলা বসেছে।
উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, ঘোড়াঘাট, রংপুর, বগুড়া, সান্তাহার, নওঁগা ও গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ পুণ্যার্থীরা ব্রহ্মপুত্র নদে গঙ্গাস্নান করতে এসেছে। আর এ অষ্টমী স্নান উপলক্ষে উপজেলার তিস্তামুখ ও বালাসীঘাট এলাকায় দই-চিড়া, মোয়া-মুরকি, কানমুচড়ি, বাতাসা, জিলাপীসহ বিভিন্ন খাদ্যের দোকান, খেলনা সামগ্রী, কসমেট্েিকর পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। এছাড়াও জেলা ও জেলার বাহির থেকে বড় বড় মাছের উঠেছে এ মেলায়।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ও বালাসিঘাটে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রতি বছরের মতো এবারও হে মহা ভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য আমার পাপ হরণ কর; এ মন্ত্র উচ্চারণ করে পাপ মোচনের আশায় পূণ্যার্থীরা আদি ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানে অংশ নিচ্ছেন।
গজারিয়া ইউনিয়নের হিন্দু সম্প্রদায়ের আয়োজনে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে প্রতি বছর এ অষ্টমী স্নানের আয়োজন করা হয়।
আয়োজক কমিটির সভাপতি নগেন চন্দ্র দাস জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে নদীর পাড়ে এ অষ্টমীর স্নানের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রতিবছর জেলা ও জেলার বাইরে থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী, শিশু ও পুরুষসহ অন্যান্য ধর্মের প্রায় ২০ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ভোরবেলা থেকেই বিভিন্ন এলাকার হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পাপমোচনের জন্য পবিত্র গীতার মন্ত্র উচ্চারণ করে কলার নৌকায় ফুল-ফল ভাসিয়ে দেন গঙ্গাদেবীর উদেশ্যে। স্নান শেষে পুণ্যার্থীদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
প্ররোহিত গোলাপ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী বলেন, ভক্তগণের বিশ্বাস এ সময় ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান খুবই পুণ্যের, এ স্নানে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভ করে পাপমোচন হয়। এই স্নানই অষ্টমী স্নান নামে অভিহিত। অধিকাংশ স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, চৈত্রের অষ্টমীতে জগতের সকল পবিত্র স্থানের পুণ্য ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়। নদীর পানি স্পর্শমাত্রই সকলের পাপ মোচন হয়। যে এই পবিত্র পানিতে স্নান করে সে চিরমোক্ষ লাভ করে। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে আমরা সবাই যেন জাতির কল্যানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারি এই কামনাই করেছি সৃষ্টিকর্তার কাছে।
স্নান উৎসবে আসা দিনাজপুরের রনিজৎ সরকার বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদে গঙ্গাস্নান করতেই দিনাজপুর থেকে এসেছি এখানে। গঙ্গাস্নানের মূল উদ্দ্যেশেই হল পাপমোচনের আশায় এবং দেশের মানুষ যাতে ভালো থাকে সেই আর্শিবাদ করেন ঈশ^রের কাছে। অষ্টমী স্নানে আসা ভরতখালীর সাবিত্রী সাহা জানান, এই দিনে নদীতে স্নান করলে ভগবান সব পাপ থেকে মুক্ত করে দেন। তাই পাপমুক্তির আশায় গঙ্গাস্নান শেষে মেলায় সংসারের প্রয়োজনীয় ও বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করবো।
পলাশবাড়ির কোমলপুর গ্রামের গৌরি রানী জানান, হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ ও শিশুরা ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করে পাপমোচনের আশায়। এ মেলায় প্রতিবছরেই দেখি নারীরা যেখানে ¯œান করে সেখানে মেলা কমিটির পক্ষ থেকে পর্দার ব্যবস্থা করা হয় না। আমি আশা করবো নারীদের জন্য এ ব্যবস্থাটি করবে আয়োজকরা। গৌরি রানী ছাড়াও দুর-দুরান্ত থেকে আগত পূন্যার্থীদের দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
সাঘাটা উপজেলার বিমল চন্দ্র বর্মণ বলেন, অষ্টমীর স্নানোৎসবে প্রচুর ভক্তদের সমাগম ঘটেছে। তবে এ মেলায় নারীদের নিরাপত্তা একটু কম। মেলায় বখাটে ছেলেদের আনাগোনা বেশি লক্ষ্যনীয়। শুধু শুধু গায়ে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এবার সকাল থেকে মেলায় প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেছে। সদর উপজেলার বাদিয়াখালীর আরতী রানী বলেন, নারীদের স্নানের পর কাপড় ছাড়ার জন্য তাম্বু দিয়ে প্যান্ডেল দু’এক করা হয়েছে। তবে মানুষের সমাগম বেশি হওয়ায় তাম্বু দিয়ে প্যান্ডেল আরও কয়েকটি করা দরকার ছিলো। শহরের মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মন্দিরা রায় মেধা জানান, মা-বাবার সাথে নদীতে ¯œান করলাম। এখন মেলা ঘুরবো, সখের জিনিস কিনবো এবং বাসার জন্য কানমুচরি, মোয়া-মুরকি, বাতাসা কিনবো। আমার খুব ভালো লাগছে।
গাইবান্ধা থেকে আশা নবদম্পতি শ্রাবণী চৌধুরী ও সুমন চন্দ্র সরকার বলেন, তাদের বিয়ের পর এটাই প্রথম স্নান। আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছি আমি সহ আমাদের পরিবারের সবাই ভালো থাকে। শান্তি পূর্ণ ভাবে স্নান করেছি। আর বিশেষ করে স্নাস উৎসবটি বুধবারে হওয়াতে অনেক লোক এসেছে। আর আমাদের ধর্ম অনুযায়ী এই দিনটি বিশেষ একটি দিন।
ফুলছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ মো: কাওছার আলীর সাথে যোগাযোগ করা তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে উপজেলার দু’টি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের গঙ্গাস্নানোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেলায় কোন বিশৃঙ্খলা ঘটেনি সে জন্য প্রশাসন আগে থেকেই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলো।
পঞ্জিকামতে চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা পবিত্র অষ্টমী স্নানে মেতে ওঠেন। এসময় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে। শুক্ল তিথি অনুযায়ী বুধবার ভোর ৪টা থেকে ৫টা ৩০মিনিট পর্যন্ত এই দেড় ঘন্টা উত্তম সময় স্নানের। আর উত্তম লগ্ন সকাল ৯টা ৯মিনিট ২৩ সেকেন্ড থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা ৯মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত চলবে।