প্রদীপ রায়►
হোসনে আরা বেগম সাধারণ কাপড়কে রঙিন ছাপ ও পুঁতির কারুকাজে আকর্ষণীয় করে তোলেন। পিছিয়ে পড়া ও অবহেলিত তিন শতাধিক নারীকেও তিনি বুটিক শিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ করে দিয়েছেন। এই শিল্পকর্ম শুধু তাঁর হাতের কাজ নয়, বরং তাঁর সংগ্রাম, সাহস ও স্বপ্নের প্রতিফলন। এক সময়ের নির্যাতিত নারী থেকে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ‘জয়িতা’ সম্মাননা। বিভাগীয় পর্যায়ে হয়েছেন ‘শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী’।
হোসনে আরার জন্ম গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের উত্তর ধানঘড়া গ্রামে। শৈশব থেকেই সংগ্রামের জীবন তাঁর। ২০০৬ সালে মাধ্যমিক পাশের পরই বিয়ে হয়ে যায় পারিবারের চাপে। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তিনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে স্বামীর সাথে চলে যেতে হয় ঢাকায়। আবার স্বামীর মাদকাসক্তি, পরকীয়া ও সহিংসতার কারণে সংসারও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। এক পর্যায়ে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নির্যাতন বেড়ে যায় আরও। বাধ্য হয়ে তিনি ৩ মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন শ্বশুর বাড়িতে। সংসারের টানাপোড়েন কাটাতে গোপনে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বুটিক প্রশিক্ষণে ভর্তি হন হোসনে আরা।
প্রশিক্ষণ শেষে হোসনে আরা সার্টিফিকেট পান। এই খবর পেয়ে স্বামী বাড়িতে আসেন। স্বামী রাগান্বিত হয়ে সার্টিফিকেট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে পুকুরের জলে ফেলে দেন। এ দৃশ্য দেখে হোসনে আরা ও তাঁর মেয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন। এই ঘটনা হোসনে আরার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে।
তিনি ভাবতে থাকেন— প্রথমে স্বামী তাঁর পড়াশোনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আর এবার তাঁর সার্টিফিকেট ছিঁড়ে আয় করার পথও রুদ্ধ করে দিল! অর্থাৎ স্বামী কখনোই তাঁর মঙ্গল চায়নি এবং চায়ও না। মন শক্ত করে হোসনে আরা সিদ্ধান্ত নেন— তিনি আর এই সংসার করবেন না। ২০২২ সালে স্বামীর সংসার ছেড়ে দেন তিনি। এবং নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্বপ্ন কুটির’। জীবন শুরু করেন নতুনভাবে।
হোসনে আরা বেগমের একাগ্রতা ও কঠোর সাধনার ফলে ‘স্বপ্ন কুটির’- এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাড়তে থাকে হোসনে আরার দক্ষতার খ্যাতিও। কাজের গুণগত মান দেখে এসকেএস ফাউন্ডেশন- এর Recovery and Advancement of Informal Sector Employment (RAISE) প্রকল্প তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়। ২০২৩ সালের জুন মাস। নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে এসকেএস ফাউন্ডেশন হোসনে আরাকে যুক্ত করে RAISE প্রকল্পের সাথে। হোসনে আরা যুক্ত হন নির্বাচিত কিছু নারীকে বুটিকের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে। RAISE প্রকল্পের আওতায় হোসনে আরার প্রশিক্ষণে ৪ জন প্রান্তিক যুব নারী ৬ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ইতিমধ্যেই স্বাবলম্বী হয়েছে। বর্তমানে আরও ২ জন নারী তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। হোসনে আরারও দিন বদলাতে শুরু করেছে।
এসকেএস ফাউন্ডেশন হোসনে আরার জীবন সংগ্রাম ও সাফল্যের কাহিনী তুলে ধরে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে। ৯ ডিসেম্বর ২০২৪। বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তাঁকে ‘জয়িতা’ পুরস্কারে ভূষিত হন হোসনে আরা। তারই সূত্র ধরে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও স্বীকৃতি পান তিনি।
হোসনে আরা চান তাঁর ৩ মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে। আর ‘স্বপ্ন কুটির’কে নারী জাগরণের কেন্দ্রে পরিণত করতে। তিনি প্রমাণ করেছেন, আত্মপ্রত্যয় আর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো বাধা জয় করা যায়।