• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২২-৬-২০২৫, সময়ঃ সকাল ১০:৩৭

তুলসী লাহিড়ীর বসতবাড়িতে স্মৃতি সংগ্রহশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চায় সংস্কৃতিকর্মীরা



কায়সার রহমান রোমেল►

বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক, গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ীর পৈতৃক ভিটা গাইবান্ধার নলডাঙ্গায় একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি করছন স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা। গাইবান্ধার নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী এবং শিল্প-সাহিত্যানুরাগী বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে তুলসী লাহিড়ীর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, যা নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের এক অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। নাট্যক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়; বিশেষ করে তাঁর লেখা ‘ছেঁড়া তার’ নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। চলচ্চিত্র জগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অভিনয়, চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনার মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর গান এবং গীতিনাট্যও বাংলা সংস্কৃতিতে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে। গ্রামোফোন কোম্পানির সুরকার, বাংলা ছায়াছবির জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার, নাটক রচনা ও অভিনয় দিয়ে নাট্য আন্দোলনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। আজ ২২ জুন তুলসী লাহিড়ীর ৬৬তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৫৯ সালের আজকের এই দিনে কলকাতায় তিনি মারা যান।

নাট্যকার তুলসী লাহিড়ী ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল (২৩ চৈত্র, ১৩০৩ বঙ্গাব্দ) গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, মাতা শৈলবালা দেবী, স্ত্রী কৃষ্ণা প্রেমাঙ্গিনী দেবী। জমিদার পিতা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী খ্যাতিমান ক্লারিওনেট বাদক ছিলেন। রংপুরে তুলসী লাহিড়ীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। রাজনৈতিক কারণে পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম হলে প্রকৃত নাম হেমেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী বদলে তিনি তুলসী লাহিড়ী নাম গ্রহণ করেন। কলকাতা সারদা চরণ ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক, বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রিপন কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি নেন। অল্প দিন পর এস্রাজ, তবলা ও সারেঙ্গীতে দক্ষতার স্বীকৃতি পান লক্ষৌয়ের মরিস মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অজর্ন করে।

প্রথমে বাবা সুরেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর কাছ থেকে সঙ্গীতের প্রেরণা লাভ করেন তুলসী লাহিড়ী। এরপরে রংপুরে শ্রীতারাপ্রসন্ন সান্যালের কাছে অভিনয় শেখেন। শেষে ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁর সহযোগিতায় ১৯২৯-এ হিজ মাস্টারস্ ভয়েস থেকে নিজের লেখা দুইটি গানের রেকর্ড প্রকাশ করেন। এইভাবে সুরকার-গীতিকার-অভিনেতা হিসেবে তুলসী লাহিড়ীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। নাট্যমঞ্চে ‘স্বয়ংবরা’, ‘পোষ্যপুত্র’, ‘মন্দির’ প্রভৃতি নাটকে সুর সংযোজন করেন। প্রগতিশীল নাট্যধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয় তাঁর। কিন্তু, নীতি ও আদর্শগত বিরোধের ফলে ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার সিনেমা জগৎ ও গ্রামোফোনের জগৎ ছেড়ে দিয়ে জলপাইগুড়ি জেলায় জমি কিনে তুলসী লাহিড়ী চাষবাসের চেষ্টা করেন। সে সময়ই কৃষকজীবনের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে এবং কৃষকদের জীবন নিয়ে সৃষ্টিশীল নাটক রচনার সূচনা হয়। জন্মস্থান গাইবান্ধা ও উত্তরবঙ্গের অভিজ্ঞতা, পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি, কৃষিজীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তরের কঠিন আঘাত, বিশেষ আদর্শবোধ ও মূল্যবোধে আস্থা তাঁকে সৃষ্টিশীল নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত করে। তিনি দক্ষ অভিনেতা হিসেবে কলকাতার ‘বহুরূপী’ ও ‘রূপকার’ নাট্যদলে অভিনয় করেন। অভিনয় করেন ৫২টি চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নাটক ও চলচ্চিত্রের আবহ সংগীতে সুরারোপ করেন। এইচএমভি ও মেগাফোন কোম্পানির সাথেও কাজ করেন। গড়ে তোলেন একটি অর্কেস্ট্রা দল। তাঁর রচিত নাটক- ঠিকাদার, দু:খীর ইমান, ছেঁড়াতার, বাংলার মাটি, লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার, মায়ের দাবি, এই যুগ, ঝড়ের মিলন, পথিক, মণিকাঞ্চন, মায়া-কাজল, চোরাবালি, সর্বহারা। এগুলোর মধ্যে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত দু:খীর ইমান ও ছেঁড়াতার ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

গাইবান্ধা থিয়েটার সভাপতি আলমগীর কবির বাদল বলেন, তুলসী লাহিড়ীর বসতবাড়িতে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে স্থানীয় শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। এই কেন্দ্রে তুলসী লাহিড়ীর জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে, নাট্যচর্চা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা যাবে। এর মাধ্যমে তুলসী লাহিড়ীর আদর্শ ও শিল্প ভাবনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।

উদীচী গাইবান্ধার সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত এই গুণী শিল্পীর জন্মভিটা গাইবান্ধার নলডাঙ্গার জমিদারবাড়িটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে এখনও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমতাবস্থায়, তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িতে একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এই সংগ্রহশালায় তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পা-ুলিপি, দুর্লভ ছবি এবং তাঁর কর্মজীবনের বিভিন্ন স্মারক সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও বিশিষ্টজনরা মনে করেন, তুলসী লাহিড়ীর মতো একজন কিংবদন্তী শিল্পীর স্মৃতি সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে নলডাঙ্গায় তুলসী লাহিড়ীর বসতবাড়িতে একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেবেন, এটাই প্রত্যাশা তাঁদের।