- মাধুকর প্রতিনিধি
- তারিখঃ ৩১-৮-২০২৫, সময়ঃ রাত ০৭:০৯
না পাওয়ার বেদনায় পৃথিবী ছেড়ে গেলেন কুঠিল সওদাগর
আমিনুল হক, ফুলছড়ি►
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল না পাওয়ার বেদনায় ভরা। জীবনভর না পাওয়ার বেদনা আর দুঃখ-কষ্ট বুকে নিয়েই শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মায়া কাটালেন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী ইউনিয়নের কছির উদ্দিন ওরফে কুঠিল সওদাগর (৯৩)।
আজ (রবিবার, ৩১ আগস্ট) দুপুরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিন সন্তানের বোঝা একাই বইতেন কুঠিল সওদাগর। তার সংসার ছিল দুঃখ-কষ্টের প্রতিচ্ছবি। প্রায় এক দশক আগে মারা যান কুঠিল সওদাগরের স্ত্রী জরিনা বেগম। এরপর থেকেই তিন সন্তানকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিলেন তিনি। তাদের সব দায়িত্ব একাই কাঁধে নেন কুঠিল সওদাগর।
মেয়ে তারামনি বেগম বিয়ের পর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এক পর্যায়ে হাত-পা ভেঙে গিয়ে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। অন্যদিকে দুই ছেলে জহুরুল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম দু’জনেই মানসিক প্রতিবন্ধী। অসহায় এই তিন সন্তানকে নিয়ে একাই লড়াই চালিয়ে গেছেন কুঠিল সওদাগর। ভোর থেকে রাত সব কাজ সামলাতেন তিনি। প্রতিবন্ধী মেয়েকে গোসল করানো, খাওয়ানো থেকে শুরু করে শৌচাগার ব্যবহারের পর পরিষ্কার করা পর্যন্ত সব দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে।
কয়েক বছর আগে ঝড়ে ভেঙে যায় তাঁদের একমাত্র বসতঘর। ঘর তোলার সামর্থ্য না থাকায় মেয়ে তারামনিকে নিয়ে আশ্রয় নেন উদাখালী ইউনিয়ন পরিষদের একটি পরিত্যক্ত ভবনে। সেখানেই দিন কাটত বাবা-মেয়ের। তবে সারাদিন মেয়েকে তালাবদ্ধ করে রাখতে হতো তাঁকে। সেই পরিত্যক্ত ভবনেই মেয়েকে গোসল থেকে শুরু করে পায়খানা-প্রস্রাব পর্যন্ত পরিস্কার করতেন বৃদ্ধ এই বাবা।
অন্যদিকে দুই মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে সেই ভাঙা ঘরের ছাপড়িতে শুয়ে থেকে রাত কাটাতেন। বৃষ্টি কিংবা শীতে ঘর ফুঁড়ে বাতাস ঢুকলেও তাদের ভাগ্যে ছিল না নিরাপদ আশ্রয়। বছর খানেক আগে কুঠিল সওদাগরকে সরকারের ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় একটি দোকানঘর করে দেওয়া হয়েছিল। দোকানের সামান্য আয় দিয়েই চলত সংসার। তবে দুই বেলা খাবার জোটানোও ছিল কঠিন। স্থানীয় লোকজনের সাহায্য সহযোগিতায় কোন রকমে জীবন চলতো তার।
এলাকার সচেতন মহলের অনুরোধে প্রায় দুই বছর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে একটি ঘরের বরাদ্দ দেওয়া হলেও সরকার পরিবর্তনের পর সেটি আর পাননি তিনি। জীবন যুদ্ধে পরাজিত কুঠিল সওদাগরের মৃত্যুর পরে বিভিন্ন শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুঠিল সওদাগরের মৃত্যুতে তাঁর তিন সন্তান আরও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। আগে অন্তত বাবা ছিলেন, এখন তাঁদের দেখভালের কেউ নেই।
প্রতিবেশী আতোয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা দেখতাম, মেয়েকে একা ঘরে আটকে রেখে দোকানে যেতেন সওদাগর। ফিরে এসে আবার সব কাজ করতেন। এটা ভাবলেই বুক ফেটে যায়।’
স্থানীয় বাসিন্দা ছইম উদ্দিন বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সেও সন্তানদের জন্য দিনরাত খাটতেন কুঠিল সওদাগর। ওনার মৃত্যুতে এ পরিবার এখন আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল। তিনি বলেন, দুই বছর আগে এলাকার সচেতন মহলের অনুরোধে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে একটি ঘরের বরাদ্দ হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সেই ঘর আর পাননি তিনি। ফলে পরিত্যক্ত ভবনেই কেটেছে জীবনের শেষ দিনগুলো।’
স্থানীয় শিক্ষক নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা দেখতাম, কী কষ্টে দিন কাটাতেন কুঠিল সওদাগর। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সন্তানদের জন্য লড়াই করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাঁর মৃত্যুর পর এই সন্তানদের দেখভাল করবে কে? এখন তারামনি ও দুই প্রতিবন্ধী ছেলের দায়িত্ব কে নেবে?’
এলাকার মানুষের দাবি, জরুরি ভিত্তিতে সরকার ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে এই পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। না হলে একেবারে অযত্ন-অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাবে শয্যাশায়ী তারামনি আর তাঁর দুই প্রতিবন্ধী ভাইয়ের জীবন।