• মাধুকর প্রতিনিধি
  • এই মাত্র

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস ও প্রতিবন্ধী মানুষের চ্যালেঞ্জ



সুলতান উদ্দিন আহমেদ►

প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও এর পেছনে রয়েছে একটি মানবিক ইতিহাস। ১৯৫৮ সালে বেলজিয়ামের ভয়াবহ খনি দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়ে আজীবন প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তখন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে এগিয়ে আসে। 

এর পরের বছর সুইজারল্যান্ডের জুরিখে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে তথ্যভিত্তিক ধারণা ও নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। সেই সম্মেলনে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, সম্মান ও সহযোগিতা লক্ষ্যে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে। দিবসটিকে কেন্দ্র করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদান, আলোচনা সভা এবং প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কার্যক্রম এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবন্ধিতা বলতে দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোনো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততাকে বোঝায়। যা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশগত বাধার কারণে তার সমঅংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, সেবা ও সুরক্ষা

নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সমন্বিত শিক্ষার মাধ্যমে মূলধারার বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী পাঠদান নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ শিক্ষার অভাব তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ায় শারীরিক বা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী তরুণরা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ লক্ষ্যেই টঙ্গীতে ১৯৭৮ সালে স্থাপিত হয় ইআরসিপিএইচ (ERCPH), যা বৃদ্ধির প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, শিক্ষা উপকরণ, কৃত্রিম অঙ্গ নির্মাণ, ব্রেইল প্রেস, হিয়ারিং এইড সার্ভিস এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে আসছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৩,২০০-এর বেশি প্রতিবন্ধী মানুষকে পুনর্বাসিত করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী মানুষের উচ্চ হার সম্পন্ন দেশগুলোর একটি BBS (২০১১) অনুযায়ী দেশে প্রায় ১১.৪ মিলিয়ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে। ২০২১ সালের জাতীয় জরিপ অনুযায়ী জনসংখ্যার ২.৮০% মানুষ প্রতিবন্ধী। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধিতা সনাক্তকরণ জরিপ (২০১৩) বিস্তৃত তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে, যা বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশে দেখা যায়। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে শনাক্ত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩,০৩৪,৫৩৯ জন। অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, দৃষ্টি ও বাক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রধান সমস্যা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার। অনেক পরিবার ও সমাজ এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বোকা হিসেবে দেখে। তাদের সক্ষমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। শ্রম-মজুরিতে বৈষম্য, চাকরিতে অগ্রাধিকার না পাওয়া, ব্যবসায় এসব কারণে তারা অংশীদার হতে না দেওয়া-অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকেও অনেক সময় তারা বঞ্চিত হয়; কারণ কিছু স্বাস্থ্যসেবিকা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এখনও প্রতিবন্ধী রোগীকে সেবা দিতে অনিচ্ছুক।

জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্যকে মানবাধিকার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক অংশগ্রহণ- সবক্ষেত্রেই তারা উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে। তাই পুনর্বাসনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করা, তার নিশ্চিত করা সম্ভব। সর্বোচ্চ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও পেশাগত সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করা এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্ত করা। বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকার সনদ (CRPD) অনুসমর্থনকারী প্রথম দেশগুলোর একটি। সনদের ১১নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুর্যোগ বা মানবিক সংকটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের দায়িত্ব। ইতিমধ্যে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ভাতা প্রদান, শিক্ষা সহায়তা, পুনর্বাসন ও কারিগরি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ সমাজকে আরও অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সহায়তা করছে।

তবে বাস্তবতা হলো প্রতিবন্ধী মানুষ এখনো প্রাপ্তিক। অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে করুণা ও দান-অনুদান নির্ভর ভাবনা তাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা-ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ, বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং প্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অংশগ্রহণ।

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমান অধিকার, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার দিন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের সক্রিয় সহযোগিতা থাকলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ ও সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ

লেখক: সাবেক উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর।