• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২৪-১-২০২৩, সময়ঃ সকাল ১০:৩২

তিস্তা সেচ খাল সংস্কারে কাটা হচ্ছে প্রায় ৪ লাখ গাছ, বিপর্যয়ের আশংকা



শাহজাহান আলী মনন, সৈয়দপুর ►

তিস্তা সেচ এলাকায় চাষাবাদ বৃদ্ধিতে সেচ খালগুলো সংস্কার করা হচ্ছে। এজন্য খালের উভয়ধারে সামাজিক বনায়নের প্রায় ৪ লাখ গাছ কাটা হবে। এতে প্রাকৃতিক বির্পযয়সহ জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।

জানা যায়, তিস্তানদীর পানি প্রবাহ কৃষিতে ব্যবহারের জন্য ১৯৯১ সালে  সৈয়দপুর, রংপুর, দিনাজপুর,  নীলফামারী, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জসহ ১২ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বিভিন্ন খাল খনন করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো

দিনাজপুর সেচ খাল, বগুড়া সেচ খাল, রংপুর সেচখাল, এস সেভেনটি খাল, এস ফোরটি খাল,  এস সিক্সটি খাল, টি-২ এস সেভেনটি খাল, তিস্তা প্রধান সেচ খাল, এস ওয়াই আর সেচ খাল, এস টু আর সেচ খাল, এস ফাইভ ডি সেচ খাল, এস এইটটি সেচ খাল, এস থ্রি-ডি সেচ খাল, এস সিক্সডি সেচ খাল, বিসিথ্রি সেচ খাল। এ সকল খালের সংযোগ রয়েছে প্রায় ৪০ টি ক্যানেলের।

পরে তত্বাবধানের অভাবে বেশির ভাগ উপ-প্রধানখাল ও সংযোগ ক্যানেল নষ্ট হয়ে যায়। বনমন্ত্রনালয় ও পানি মন্ত্রনালয় সমন্বিত ভাবে নানা শর্তে চুক্তির স্বারকে এ সকল খাল ও সংযোগ ক্যানেলগুলোর উভয় ধারে সামাজিক বনায়নের বৃক্ষ রোপন করেন। মেয়াদ পুর্তিতে কেটে পুনরায় রোপন করা হয় চারা।  

এভাবে স্থানীয় বনবিভাগ ও উপকারভোগীর মাধ্যমে ২০০২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, জারুল, পারুল, বহেরা, হরতকি, নারকেল, আম, জাম, বট, ডুমুর, গামার, গুটি, মেহগনি, সাদা কড়ই, রেইনট্রি, কটিগুয়া, পাকুড়, জলপাই, রাজকড়াই, বকহিন, কদম, পাউয়া জিগা, জিগনি, কাঠাল, মিল কড়ই, তরুল, পলাশ, বাবলা, শিশু, আমলকি, নুনাতি, ছাইতন, অর্জুন, মানডাল, চাম্পা, সোনালু, কৃষ্ণচুড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতীর বনজ, ফলজ ও ওষুধী গাছ রোপন করেন। 

এতে কয়েক বছরেই উত্তরের ওই সকল এলাকার প্রকৃতিকে সবুজ রঙ্গে সাজিয়ে তুলে। গ্রীস্মের তপ্ত রোদে খালের বাধে সবুজ ছায়ায় কৃষক-কৃষানী, পথচারিরা এর সুশীতল ছায়ায় অবসর কাটান। বিকালে জমাট আড্ডায় মেতে ওঠেন স্থানীয় বিভিন্ন বয়সীরা। 

একেকটি গাছ যেন অনাবিল শান্তির শ্বাষ-প্রশ্বাষ গ্রহনের এক কারখানা। খাল-ক্যানেলে বহমান পানি ও তার বাঁধে সবুজ বনায়ন ভিন্ন সৌন্দর্যের ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। সেখানে অনাবিল আনন্দে মাতোয়ারা থাকত সকলে। সম্প্রতি কৃষিতে পানি সরবরাহ বৃদ্ধির নামে বিশাল এলাকাজুড়ে সামাজিক বনায়নের বৃক্ষরাজি ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে সংশ্লিষ্টরা। 

এ নিয়ে রংপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মতলুবুর রহমান জানান, কৃষিতে ফলন বাড়ার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই প্রকল্পের গাছগুলো সরাতে হচ্ছে। কারণ এই শর্তে সেখানে  গাছ রোপন করা হয়েছিল। তবে তারা যে গাছ নষ্ট করছে সে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত আছি। বিশাল এ বনায়নের গাছ অপসারনের পর আবারও রোপন হবে। একটু সময় লাগবে। এতে প্রকৃতিতে প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে করার কিছুই নেই। 

জনবল স্বল্পতার দোহাই দিয়ে বিশাল সামাজিক বনায়নের গাছগুলো অপসারন প্রক্রিয়ায় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরামর্শে আলোচনা করে তারপর ব্লেজিং, নাম্বার বসানো, পরিমাপ এবং টেন্ডারের পর বিক্রি করার কথা। কিন্তু এতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। তাই এ সবের কোন কিছুই মানতে চায়না পানি উন্নয়ন বোর্ড। তারা উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞে বাঁধে প্রায় লক্ষাধিক গাছ নষ্ট করেছেন। পাশাপাশি অনেক এলাকায় ব্লেজিং, নাম্বারিং ও পরিমাপ করা গাছগুলোকে এস্কেভেটর মেশিন দিয়ে মাটির স্তুপের নিচে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। 

আর এমন দৃশ্য দেখা গেছে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নে বগুড়া খালের চৌমুহনি নামক এলাকায়। এতে টেন্ডার হলেও সঠিক মুল্য থেকে বঞ্চিত হবেন উপকারভোগী ও বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ। ওই বনায়নের উপকারভোগী দলের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, গাছগুলো খাল থেকে অনেক দুরে। 

এমনকি বাঁধের এক কিনারে। তাদের খনন ও বাঁধ পুন:নির্মাণ কাজে কোন সমস্যা হত না। তারপরেও এ সকল গাছ অপসারনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। গাছকে ধ্বংসের নির্দেশ দাতারা দেশপ্রেমিক হতে পারে না। তারা শুধু পকেট ভারি করতে পানির উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের সামাজিক বনায়ন এলাকার সভাপতি মোহাইমিনুল ইসলাম ঝন্টু জানান, আমাদের বাগানটি সংযোগ ক্যানেলের দুই ধারে ১৫ কিলোমিটারে ১৫ হাজার চারা ২০১৯ সালে রোপন করা হয়েছে। ৭৫ জন উপকার ভোগীর নিয়মিত যত্নে গাছগুলো ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতা হয়েছে। এগুলো বিক্রি করলে চুলার খড়ি ছাড়া কিছুই হবে না। তাই কোন মুল্য পাওয়া যাবে না। কিভাবে তারা এই অপরিপক্ক গাছগুলো নিধন করবে? বিষয়টি ভাবলেই চোখে পানি আসছে। 

ওই সকল খাল ও ক্যানেলে বিদ্যমান সামাজিক বনায়নের প্রায় ৪ লাখ বৃক্ষ অপসারন করতে হচ্ছে বন বিভাগকে। আর বিশাল সংখ্যক বৃক্ষরাজি ধ্বংস করায় উত্তরের এ জনপদ গুলোতে চলতি মৌসুমেই প্রকৃতির উপর বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। 

সৈয়দপুর বিমানবন্দরের আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ লোকমান হাকিম বলেন, প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলে গ্রীস্মকালে উষ্ণতা বাড়ছে। গত বছর গড় তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৩৫ ও সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফারেনহাইট। এতে  প্রচন্ড দাবদাহ হয়েছিল। আর বিশাল এলাকার সবুজ বৃক্ষ কর্তন করা হলে আগামিতে এ অঞ্চলে মরুকরনের আশংকা রয়েছে। তাই এখনই সচেতন হওয়া উচিত। 

এ নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও সৈয়দপুর সরকারী ডিগ্রি কলেজের  সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন খোকন বলেন, ভুপৃষ্ঠের মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ বনভূমি বা বনাঞ্চল। গাছই হচ্ছে ধরনীর ফুসফুস। গাছ থেকে অক্সিজেন গ্রহনের পাশাপাশি এর ছায়া মাটিকে আর্দ্র ও চারপাশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখে। তাই বৃক্ষ নিধন হলে আদ্রতা কমে শুকিয়ে যায় গাছপালা। বিপর্যয় ঘটে প্রকৃতির। যার কারণে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যায়। প্রকৃতি ও মানবকল্যাণে গাছ নিধন করা উচিত নয়। সরকারকে ধোয়াশায় রেখে এই উন্নকর্মকান্ড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক ফসল ফলাতে সংশ্লিষ্টরা সেচের পানি নিশ্চিত ব্যবস্থাপনার ২০২১ সালে  ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্প হাতে নেয়। পরবর্তিতে ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল সংশ্লিষ্টরা তৃতীয় দফায় ভার্চুয়াল আলোচনার মাধ্যমে চুড়ান্ত হয় এ প্রকল্পের রুপরেখা।

১ হাজার ৪৫২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যায় বরাদ্দে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড ওই বছরই তড়িঘড়ি করে শুরু করেন তাদের সকল খাল ও ক্যানেলে সংস্কারের কাজ। যার মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। সেখানে ৭৬৬.৩১ কিলোমিটার ‘ডাইক’ পুনবার্সন ও শক্তিশালী করা, ৭২ কিলোমিটার সেচ পাইপ স্থাপন, প্রটেকশন বাঁধ ১০ দশমিক ০৮ কিলোমিটার ও মেরামত করা হবে ১.০৬ কিলোমিটার। সাথে বাইপাস সেচ খাল নির্মাণ করা হবে ৭ দশমিক ১৩ কিলোমিটার। 

পাশাপাশি ২৭টি কালভার্ট, ৪টি সেতু নির্মান ও ২৭০ হেক্টর জলাধার ও সাড়ে নয় কিলোমিটারের চ্যানেল পুনঃখনন, ৬ কিলোমিটার পরিদর্শন, ৫২.২৯ কিলোমিটার পরিদর্শন সড়ক নির্মাণ ও মেরামত, ৫৭টি নিকাশ কাঠামো নির্মাণ ও ৩টি মেরামত, ২০টি রেগুলেটর নির্মাণ ও ৬টি রেগুলেটর মেরামত এবং ১৮টি অনাবাসিক ভবন মেরামতের পর ৮৭ হাজার গাছ রোপণ করতে হবে।