• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ১৩-৪-২০২৩, সময়ঃ বিকাল ০৫:৩৮

রেশন কার্ডের চাল কম দেয়ার জন্য দায়ী কে, ডিলার না খাদ্য কর্মকর্তা? 



শাহজাহান আলী মনন, সৈয়দপুর ►

বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া নিম্ন ও মধ্য বিত্ত লোকজনের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় সাশ্রয়ী দামে চাল বিক্রি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার। ব্যাপক ভুর্তুকি দিয়ে মাত্র ১৫ টাকা কেজি দরে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল কেনার সুবিধা পাচ্ছেন তৃণমূল পর্যায়ের অসংখ্য পরিবার। 

কিন্তু সরকারের এই মহৎ উদ্যোগে অনিয়ম ও দূর্নীতির ফলে সুবিধাভোগীরা ঠকছেন প্রতিনিয়ত। প্রতিবারই তাদেরকে ন্যুনতম ৩শ' গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত কম চাল দেয়া হচ্ছে নানা অজুহাতে। প্রতারণামুলক এই অবৈধ কাজ চলছে প্রকাশ্যে ও সচরাচর। 

এইক্ষেত্রে কম দেয়াকে বৈধ বা জায়েজ করতে পরস্পরের প্রতি দায় চাপিয়ে নিজেকে ধোয়া তুলশী পাতা প্রমাণ করতে ব্যস্ত ডিলার ও খাদ্য কর্মকর্তারা। শুরু থেকেই এই দোষারোপের খেলা চললেও মূলতঃ ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ জনগণ।

নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ৫ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মোট ৩২ জন ডিলারের অধীনে মোট ১৫ হাজার ৩৩৭ জন রেশন কার্ডধারী এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কার্ডধারীরা ৪৫০ টাকায় ৩০ কেজি চাল কিনে নেন।

কিন্তু ডিলারদের অধিকাংশই ৩০ কেজির স্থলে ২৯ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ২৯ কেজি ৬শ' গ্রাম চাল দেয়। গ্রাহক প্রতি এভাবে কম দেয়াটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এইক্ষেত্রে যারা ৫০ কেজি ওজনের বস্তা বরাদ্দ পায় তারা খোলাভাবে চাল মেপে দেয়ার সময় কম দেয়ার কারসাজি করে। 

আর যারা ৩০ কেজি ওজনের বস্তা বরাদ্দ পায় মাপার ধারও ধারেনা। গোটা বস্তা ধরিয়ে দেয় গ্রাহককে। এতে অধিকাংশ বস্তাতেই চাল কম থাকার খবর পাওয়া গেছে। এতে ডিলারদের মন্তব্য গ্রাহক সংখ্যা অনুযায়ী সমপরিমাণ বস্তা দিয়েছে এলএসডি। কোন ওজন করা হয়নি। তাই কম বা বেশি থাকলে তার জন্য দায়ী আমরা নই। বরং খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে ৫০ কেজির বস্তা খুলে ৩০ কেজি চাল প্রদানকারী ডিলারদের বক্তব্য এলএসডি থেকে ছেড়াফাটা বস্তা দেয়ায় লোড-আনলোডসহ নানা কারণে চালের ঘাটতি হয়। তাছাড়া বস্তা প্রতি মাত্র ৭শ' গ্রাম ওজন ধরে বাদ দেয়া হয়। অথচ বস্তার ওজন ৭২০ থেকে ৮শ' গ্রাম পর্যন্ত হয়। এখানেও আমরা কম চাল পাই। 

এভাবে কম দেয়ায় ঘাটতি পূরণ করতে আমরাও কম দিতে বাধ্য হই। তবে ৪শ'-৫শ' গ্রাম কম কোন ব্যাপার নয় বলে মন্তব্য করে এক ডিলার বলেন, আমার বরাদ্দ অনুযায়ী ৫০ কেজির ৩০১টি বস্তা প্রাপ্য। কিন্তু আমাকে দেয়া হয়েছে ২৯৯ বস্তা। অর্থাৎ ২ বস্তা তথা ১০০ কেজি চাল কম দিয়েছে এলএসডি। এখন আমি কম না দিলে সব গ্রাহককে চাল দিবো কিভাবে?

বুধবার (১২ এপ্রিল) উপজেলার বোতলাগাড়ী, কাশিরাম বেলপুকুর ও খাতামধুপুর ইউনিয়নে সরেজমিনে গেলে চাল কম দেয়ার অভিযোগের হাতে নাতে সত্যতা পায় সাংবাদিকরা। এসময় ডিলাররা উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।  প্রায় সব ডিলারের ভাষ্য হলো, চাল তোলার সময় এলএসডি'র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ন্যুনতম ১ হাজার টাকা বকশিশ দিতে হয়। আর ৫০ কেজির বস্তা নেয়ার জন্য অতিরিক্ত ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা গুনতে হয়। 

সূত্র মতে, তারপরও ৫০ কেজির চটের বস্তা নিতে রীতিমত প্রতিযোগীতা করে ডিলাররা। কারণ বস্তাগুলো ৬০-৭০ টাকা পিস দরে প্রায় ১১ থেকে ১৩ হাজার টাকা বিক্রি করা যায়। সেইসাথে ওজন করে দেয়ার সময় কম দিতে সুবিধা হয়। গ্রাহক প্রতি ন্যুনতম ৪শ' গ্রাম করে কম দিলে প্রতিটা ডিলার কমপক্ষে আড়াইশ কেজি অর্থাৎ ৫ বস্তা চাল চুরি করতে পারে।

যা বিক্রি করে আরও ১০ থেকে ১২ হাজার অতিরিক্ত আয় হয়। আর সরকার নির্ধারিত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা কমিশনতো আছেই। এভাবে বৈধ অবৈধ মিলিয়ে ডিলাররা প্রতিবার ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় এবং এলএসডি কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক কর্মচারীরা বকশিশ অর্জন করলেও সাধারণ গ্রাহকরা সবসময়ই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েই যাচ্ছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রাহক বলেন, চাল কম দেয়ার প্রতিবাদ করলে ডিলাররা বলে এমনিতে ১২ শ' টাকার চাল পাচ্ছেন মাত্র সাড়ে ৪ শ' টাকায়। তার উপর আবার মাপ ঠিক চাচ্ছেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কার্ড বাতিল করার ভয়ও দেখায় তারা। চেয়ারম্যান মেম্বাররা বলে এবিষয়ে তাদের করার কিছুই নাই। এগুলো দেখবে ইউএনও ও খাদ্য অফিস। 

এব্যাপারে সৈয়দপুর উপজেলা খাদ্যগুদামের ((এলএসডি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীমা নাছরিনের সাথে কথা হলে চাল কম দেয়া বা বকশিশ নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, নিয়মানুযায়ী সিরিয়াল মত খামাল থেকে মাল দেয়া হয়। এতে কেউ ৩০ কেজি আবার কেউ ৫০ কেজির বস্তা পায়। গ্রাহককে কম দেয়ার অজুহাত হিসেবে ডিলাররা মনগড়া তথ্য দিয়েছে। 

তিনি বলেন, বরং আমি ওজন করার পর প্রত্যেক ডিলারকে ২ বস্তা করে চাল বেশি দেই। যাতে ঘাটতি না হয়। আপনি কিভাবে এই অতিরিক্ত চাল দেন প্রশ্ন করলে ভ্যাবাচেকায় পড়ে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান এবং দ্রুত সটকে পড়েন।

কোন কোন ডিলার চাল তোলা নিয়ে  এলএসডি কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বকশিশ বাণিজ্যের চাপের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে, লোড-আনলোড, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও লেবার খরচ দিয়ে ৬ থেকে ৮ হাজারের বেশি লাভ করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই ডিলারশিপ ছেড়ে দিলেই যেন বাঁচি।

এমনিতে এমপি, চেয়ারম্যান, দলের নেতা, অফিসারদের ধরে ৩-৪ লাখ টাকা খরচ ডিলারী নিতে হয়েছে। সেখানে এই সামান্য আয় আর নানা ফ্যাকরা কাটিয়ে ব্যবসা করা কঠিন। তাই এই ডিলারী কোন কাজের নয়। বরং শুধু বদনাম। 

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জহুরুল হক বলেন, কোনভাবেই চাল কম দেয়ার সুযোগ নাই। ডিলারের বিরুদ্ধে চাল কম দেয়ার কোন অভিযোগ গ্রাহকরা করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদারকির জন্য লোকবল দেয়ার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানানো হয়েছে। সামনে আর এমন কিছু ঘটবেনা। 

সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, চাল কম দেয়ার তথ্যের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হানের নির্দেশে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) সকালে উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীমা নাছরিন সকল ডিলারকে ডেকে সতর্ক করেছেন মাত্র। অভিযোগ তদন্তে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আর ইতোমধ্যে ডিলারদের চাল বিক্রি শেষ হওয়ায় এই তলবকে আইওয়াস হিসেবে দেখছেন সচেতন মহল।