• মাধুকর প্রতিনিধি
  • তারিখঃ ২৮-৩-২০২৩, সময়ঃ বিকাল ০৪:৪০

সচেতন থাকতে হবে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে



খ ম মিজানুর রহমান রাঙ্গা ►

জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ হলো নিজের স্বাস্থ্য। শরীর স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে কোন কিছুই ঠিক থাকে না। মেধা মনন কাজে লাগিয়ে যতই উন্নত, আভিজাত্য আর নিজেকে সমৃদ্ধশালী করা যাক না কেন, নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি কিংবা শারীরিক সমস্যা থাকলে সবই মিছে মনে হয়। শরীর ভাল না থাকলে কোন কিছুরই যেন দাম নাই।

তাই সময় থাকতেই নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যতœবান হওয়া জরুরী। সচেতন থাকতে হবে শরীরের প্রতি। না বুঝে আমরা অনেক ভুলের সাথে জরিয়ে থাকি। যা দিনের পর দিন ধরে আমরা করে আসছি। প্রতিদিনের নিয়মিত সকল কাজের ন্যায় নিজের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্যও সময় নির্ধারন করতে হবে। অভ্যাস করতে হবে রুটিন মাফিক শারীরিক নানা প্রয়োজনীয় কাজের। চলাফেরায় নানা অসচেনতায় নেমে আসতে পারে অনেক জটিলতা। যা অনেক সময় বয়ে বেড়াতে হয় সাড়াটা জীবন। নিভেও যেতে পারে জীবন প্রদীপ।

এমনই কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গত কয়েকমাস আগের কথা। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সের মামুনুর রশিদ গামেন্টে চাকুরী করেন। দুবছর আগে থেকে মাথা ব্যথা করে। মাথা ব্যথার জন্য ছোট খাটো চিকিৎসাও করেন। দু এক সপ্তাহ পর পর প্রচন্ড মাথা ব্যথা ওঠে। যখন ব্যথা ওঠে অনেকটা এলোমেলো হয়ে যায় কথা। হঠাৎ ট্রেনে উঠলে প্রচন্ড মাথা ব্যথায় লুটে পরে।

দ্রুত বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন নিউরো মেডিসিন স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখানোর পর জানা যায় ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত সে। ব্রেইনে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ। চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসা চলা অবস্থায় একদিন পরই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। তার তিনদিন আগেই ৬০ বছর বয়সের আইয়ুব আলী সকালবেলা খাওয়া দাওয়া শেষে পান চিবুতে থাকা অবস্থায় মাথা ও গা ঘেমে উঠে মাটিতে লুটে পরে। হাসপাতালে নিয়ে জানা গেলো ব্রেইনে রক্তক্ষরণ জনিত স্ট্রোকে আক্রান্ত। চিকিৎসা অবস্থায় দুইদিন পর তারও মৃত্যু হয়।

এভাবে শুধু মামুন আর আইয়ুব আলীই নন। উদাহরণ অগনিত। একের পর এক নানা বয়সের মানুষই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মুত্যু পথযাত্রী হচ্ছেন। কেউ বা একহাত এক পা প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে রয়েছেন দির্ঘদিন ধরে। একই এলাকার তরতাজা যুবক জাকির হোসেন, মামুনুর রহমান, আতাউর রহমান সহ অনেকেই দির্ঘদিন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এসব হলো একটি এলাকার ঘটনা। দেশের অনেক জেলার চিত্র এমনই।

অনেকে আবার দির্ঘ চিকিৎসা, ব্যায়াম ও থেরাপিতে সেরেও উঠছেন। এক্ষেত্রে একটি লক্ষনীয় ব্যাপার হলো- বর্তমানে স্ট্রোকে আক্রান্তের কোন বয়সসীমা নেই। মাত্র  ১৫ বছর থেকে শুরু করে যেকোন বয়সের লোকজনই এ রোগে মৃত্যুবরণ করছেন। চিকিৎসকদের মতে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, ধুমপান, উচ্চ রক্তচাপ, ব্যায়াম না করা, ডায়াবেটিক ও দু:শ্চিন্তাই এ রোগের প্রধান কারন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশেও বিগত বছরের চেয়ে এবার এ রোগে আক্রান্তের হার বেশি। এক বছরে স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিলেন ৪৫ হাজার ৫০২ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা বলছেন, সচেতনতার ঘাটতি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রবণতা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনসহ নানা কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। এ কারণে মৃত্যুও বাড়ছে।

এই পরিস্থিতিতে দেশের চিকিৎসা স্বাস্ত্রে বিগত বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ‘প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান’। মুল্যবান মনে করেই কাটাতে হবে প্রতিটি মুহুর্ত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে হৃদ্রোগের পরেই স্ট্রোকের অবস্থান। এ ছাড়া পংগুত্ব বা শারীরিক অক্ষমতার জন্য স্ট্রোককেই বেশি দায়ী করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ট্রোক দুই ধরনের। এক, রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দুই, রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলো শরীরের ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে চোখে কম দেখা, মাথা ঘোরানো, অচেতন হয়ে পড়া, শরীরের এক দিক অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে বছরে দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকজনিত সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে স্ট্রোকে মৃত্যু হয় প্রায় ৫০ লাখের বেশি। বাকিদের স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতজনিত সমস্যা বরণ করে নিতে হয়। এই রোগীরা পরিবারের বোঝা হয়ে যান। চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। তবে শিশুদেরও স্ট্রোক হতে পারে।

দেশে স্ট্রোকের রোগী বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক মো. বদরুল আলম বলেন, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বয়স বাড়লে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। সে হিসেবে মৃত্যুও বাড়বে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বি বেশি থাকা, ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য গ্রহণ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

দেশে এসব গ্রহণের হারও বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মানুষের অস্বাস্থ্যকর খাবার ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রবণতা। করোনার সময়ে অনেকেই দুশ্চিন্তা ও নানা মানসিক চাপে ছিল। স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধির এটিও একটি কারণ হতে পারে। সে কারণেও ২০২০ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে থাকতে পারে।

এব্যাপারে কথা বললে, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন ও মেডিসিন স্পেশালিস্ট ডা: ফখরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, কম বয়স থেকে ধুমপান ও নানা বদ অভ্যাস এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনও স্ট্রোকের ক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। তাই উচ্চ রক্তচাপ, ওজন, ডায়াবেটিস নিয়মিত খাদ্যাভাস বিষয়ে সচেতন থাকা সহ নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন জরুরী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল ২০১৮ সালে স্ট্রোক নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। দেশের ৬৪টি জেলার ২৫ হাজার ২৮৭ মানুষের ওপর করা ওই জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশে এখন প্রতি হাজারে ১১ দশমিক ৩৯ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী আছে। ৬০ বছরের বেশি মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৭ গুণ বেশি। নারীর চেয়ে পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। স্ট্রোকের প্রকোপ শহরের চেয়ে গ্রামে কিছুটা বেশি। তার কারন হিসেবে লক্ষ্য করা যায় গ্রামের মানুষ অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন। শারীরিক নানা অসুবিধা তারা অনেকটা পুষে রাখার কারনেও রোগ পরে জটিল হয়।

এতকিছুর মাঝে চিকিৎসা ভালো দিকটাও আমাদের আশার দেখায়। ডাক্তারদের মতে, স্ট্রোকের নানা উপসর্গ দেখা দিলে কিংবা হাত পা অবস জনিত সমস্যায় ভুগলে কখনোই বাড়িতে দেরি নয়। রোগিকে যত দ্রুত সম্ভব মেডিকেলে নিতে হবে। বর্তমানে দেশে সময়পযোগী উন্নত চিকিৎসা সরকারী ভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। কোন ভাবেই ঝাঁড় ফু করে অযাথা সময় ব্যয় করা যাবে না। দেরি করলে রক্তক্ষরণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জটিলতা বাড়তে পারে। তাই স্বাস্থ্য বিষয়ে সব ক্ষেত্রে সচেতনতাই পারে আমাদের বিপদ থেকে বাঁচাতে।

লেখক: গণমাধ্যম ও উন্নয়ন কর্মী