- মাধুকর প্রতিনিধি
- এই মাত্র
১৮ পেরিয়ে অন্তরঙ্গ থিয়েটার : মঞ্চে পরিপক্বতার উজ্জ্বল প্রকাশ
কায়সার রহমান রোমেল, গাইবান্ধা►
গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (গানাসাস) প্রাঙ্গণ জুড়ে ১০ অক্টোবর বিকেল থেকে উৎসবের আমেজ। রঙিন ব্যানার-ফেস্টুন, আলো-সাজ আর প্রাণবন্ত মুখরতা —সব মিলিয়ে যেন এক অভিনব নাট্য-উৎসবের আবহ। আয়োজক অন্তরঙ্গ থিয়েটার। তাদের পথচলার ১৮ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন।
দীর্ঘ দেড় যুগের নাট্যচর্চার স্মৃতি যেন ফিরে এলো সংগঠনটির প্রকাশিত স্মরণিকায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অন্তরঙ্গ মঞ্চস্থ করেছে ১৮টি মঞ্চনাটক, ১১টি পথনাটক এবং সাতটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’, ‘শিয়ালু পীরের মাজার’, ‘রক্তভেজা পতাকা’, ‘ভালোবাসার লাল গোলাপ’, ‘স্বাবলম্বী’ ও ‘বাল্য বিয়ে’ —এসব নাটক শুধু স্থানীয় মঞ্চেই নয়, গাইবান্ধা অঞ্চলের নাট্য রসিকদের ভাবনাতেও জায়গা করে নিয়েছে।
তবে ১৮ বছর পূর্তির আয়োজনে ছিল না কোনো আড়ম্বর। বরং নাটকের মধ্য দিয়েই নিজেদের মঞ্চ যাত্রার এই অধ্যায় উদ্যাপন করল অন্তরঙ্গ থিয়েটার। বিকেলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার পর সন্ধ্যায় শুরু হয় প্রথম দিনের অনুষ্ঠান ‘স্বপ্নের সিঁড়িতে আমরা’। উদ্বোধনী আসরে গুণিজন সম্মাননা প্রদান করা হয় নাট্যকার, অভিনেতা ও নির্দেশক আকতারুজ্জামান ফারুকী, শাহ আলম বাবলু, শিরিন আকতার এবং অভিনেতা ও সংগঠক সাজ্জাদ জাহীর নাজিমকে।
১১ অক্টোবর দ্বিতীয় দিন মঞ্চস্থ হয় যাত্রাপালা ‘তিনমাত্রা’ —রচনা ও নির্দেশনা অন্তরঙ্গের সভাপতি সাজু সরকারের। যাত্রার ঐতিহ্য ও সমকালীন বাস্তবতার মিশেলে নাটকটি দর্শকদের নতুন এক অভিজ্ঞতা দেয়। তৃতীয় দিন, ১২ অক্টোবর, সন্ধ্যায় মঞ্চে ওঠে ‘পাথর সময়’ —রচনা ও নির্দেশনায়ও সাজু সরকার। মঞ্চসজ্জা, পোশাক, আলোক পরিকল্পনা, সংগীত এবং অভিনয়ে প্রতিটি অংশেই দেখা যায় দলটির শিল্প নৈপুণ্য ও পরিকল্পিত উপস্থাপনা। নাটকের গতি ও সংলাপের দৃঢ়তা দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। করতালির ঝড়েই যেন মাপা যায় অন্তরঙ্গ থিয়েটারের এই ১৮ বছরের অর্জন।
উৎসব শেষে ১৩ ও ১৪ অক্টোবর গাইবান্ধা সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করবে সংগঠনটি —যা নাট্যচর্চার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রকাশও বটে।
অন্তরঙ্গ থিয়েটারের সভাপতি সাজু সরকার বলেন, ‘মুক্তচিন্তা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্য নিয়ে ১৮ বছর আগে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও আমরা চেষ্টা করেছি দর্শকদের নতুন কিছু দিতে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় অন্তরঙ্গ যেন এক ছোট অথচ দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে —এটাই আমাদের প্রাপ্তি।’
তার কথায় যেমন প্রতিফলিত হয় সংগ্রামের গল্প, তেমনি বোঝা যায় এক প্রজন্মের সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা। নাটকের মাধ্যমে সমাজের অসংগতি, অন্যায়, বাল্যবিয়ে কিংবা কুসংস্কার —সব কিছুর বিরুদ্ধে অন্তরঙ্গের অবস্থান সবসময় স্পষ্ট। মঞ্চনাটক ও পথনাটক উভয় ধারায় দলটি সমাজসচেতন ও মানবিক বার্তা তুলে ধরেছে ধারাবাহিকভাবে।
গাইবান্ধা, উত্তরাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অঞ্চল। তবে রাজধানীকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার বাইরে প্রান্তিক এই জেলায় দীর্ঘদিন ধরে যে-সব দল নাটকের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে, অন্তরঙ্গ থিয়েটার তাদের অন্যতম। স্থানীয় শিল্পীদের মেধা, পরিশ্রম ও আবেগে গড়া এই দলটি জেলা পর্যায়ে নাট্য আন্দোলনের ধারাকে পুনর্জীবিত করেছে। নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত গাইবান্ধার অনেক তরুণ এখন বিভিন্ন জাতীয় নাট্যদলে কাজ করছেন, কেউ বা নাট্য পাঠ ও নির্দেশনায় উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন —যার সূত্রপাত অন্তরঙ্গের মতো স্থানীয় সংগঠনের হাত ধরে। শুধু নাটক নয়, গান, আবৃত্তি, সংগীত নাট্য ও সামাজিক উদ্যোগেও দলটি সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
গাইবান্ধার মতো জেলা শহরে থিয়েটার চর্চা সহজ নয়। পেশাদার মঞ্চ, পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা বা প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব, অর্থসংকট, দর্শক টানার চ্যালেঞ্জ —সবই প্রতিদিনের বাস্তবতা। তবু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই অন্তরঙ্গ থিয়েটার টিকে আছে একাগ্রতা ও ভালোবাসার জোরে। দলটির সদস্যরা পেশায় শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী কিংবা কর্মজীবী —তবু মঞ্চই তাঁদের নেশা ও নিত্য চর্চা। প্রতিটি নাটকের পেছনে থাকে কয়েক মাসের প্রস্তুতি, মহড়া, পোশাক ও মঞ্চ নকশা তৈরির শ্রম। গাইবান্ধার মাটিতে এই শ্রমের বিনিময়েই গড়ে উঠেছে এক প্রজন্মের সাংস্কৃতিক বোধ।
তিনদিনের উৎসবে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গাইবান্ধা আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ জার্জিস কাদের সবুজ, আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মনিরুল হক, এএইচএম মনোয়ার হোসেন লাবলু, এটিএম মমতাজুল করিম, শাহানা ইয়াসমিন লাকী, ফারুক শিয়ার চিনু, অ্যাড. একেএম হানিফ বেলাল, মো. শামীম প্রামাণিক বাদল, মো. জাহাঙ্গীর কবীর, আলমগীর কবীর বাদল ও হেকিম মো. শামীম মিয়াসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। অতিথিদের বক্তব্যে উঠে আসে গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার আহ্বান এবং অন্তরঙ্গ থিয়েটারের প্রতি কৃতজ্ঞতা। দর্শকেরাও বলেন, ‘এখনকার প্রজন্মকে যদি মঞ্চের মানবিক গল্পের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সমাজ আরও সচেতন হবে।’
১৮ বছরের পথচলায় অন্তরঙ্গ থিয়েটার প্রমাণ করেছে, নাটক কেবল বিনোদন নয়, এটি সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ারও হতে পারে। নাটকের আলোয় গাইবান্ধার তরুণেরা যেমন বেড়ে উঠছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার মঞ্চ। অন্তরঙ্গের এই দীর্ঘ যাত্রা তাই শুধু একটি সংগঠনের ইতিহাস নয় —এটি প্রমাণ, প্রান্তিক জনপদেও শিল্পচর্চা টিকে থাকে, যদি থাকে ভালোবাসা, অঙ্গীকার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা।